ছুটে গিয়ে ঝিঁঝিকে মুক্তি দেবার প্রচণ্ড ইচ্ছেটা জোর করে রোধ। করল রবিন। পোকাটাকে সরিয়ে আনতে হলে জাল ছিঁড়তে হবে মাকড়সার। হয়ত বা মাকড়সাটাকে আহত করতে হতে পারে। কিন্তু সেটা অসম্ভব। ভ্যারানিয়ার সৌভাগ্যবাহী প্রাণীর গায়ে আঙুল ছোঁয়ালেই মৃত্যুদণ্ড হয়ে যাবে তার।
কই, তোমার আফ্রিকান প্রবাদের কি হল? মুসার দিকে ফিরে বলল রবিন। আমাদের সৌভাগ্য আনতে গিয়ে ওই বেচারাকেই মরতে হল। ভাবছি, আমরাও না আবার রোজারের জালে জড়িয়ে মরি, ওই ঝিঁঝিটার মতই!
চুপ করে রইল মুসা।
খাটের তলায় পাওয়া গেল না, রূপালী মাকড়সা। বেরিয়ে এল রবিন। আলমারির সমস্ত ড্রয়ার খুলে মেঝেতে ফেলেছে মরিডো আর কিশোর। ফোকরে হাত ঢুকিয়ে দেখছে।
মনে হয়, ফিসফিস করে বলল কিশোর, নদীতেই পড়ে গেছে। মাকড়সাটা! গার্ডেরা পায়নি, আপনি শিওর তো? মরিডোকে জিজ্ঞেস করল সে।
শিওর, বলল মরিডো। ভয়ানক খেপে আছে ডিউক রোজার। মাকড়সাটা পেয়ে গেলে অন্যরকম থাকত তার মেজাজ। পেছনে এসে দাঁড়ানো রবিনের দিকে ফিরল সে। আলো ফেলল তার গায়ে।
এদিক ওদিক মাথা নাড়ল রবিন ধীরে ধীরে। সেই আগের মতই অন্ধকারে ঢেকে আছে তার স্মৃতির কয়েকটা মিনিট। কিছুতেই ঢাকনা। সরাতে পারছে না ওখান থেকে।– ঠিক আছে, আবার একবার খুঁজে দেখি সারা ঘর, বলল মরিডো। কিশোরের দিকে ফিরল। আসুন, আমরা সুটকেসগুলো দেখি। মেরি, তুমি দেখ বালিশের খোলের ভেতরে। গদিটাও তুলে দেখ আরেকবার।
জানে ওরা, বৃথা সময় নষ্ট, তবু আরেকবার খুঁজে দেখল।
পাওয়া গেল না রূপালী মাকড়সা।
ঘরের মাঝখানে এসে জড়ো হল সবাই।
নেই এ ঘরে, কাঁপছে মরিডোর গলা। রোজারের লোকেরা পায়নি, আমরা পেলাম না, তারমানে গেল রূপালী মাকড়সা। নদীতেই পড়েছে ওটা! পাওয়ার আশা নেই আর।
তাহলে, কি করব এখন আমরা? বলল কিশোর। স্বেচ্ছায় নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছে মরিডোর হাতে। এছাড়া গতি নেই এপ্রাসাদে। ওর। সাহায্য ছাড়া এখানে কিছুই করতে পারবে না তিন গোয়েন্দা।
বেরিয়ে যাব, বলল মরিডো। নিরাপদ জায়গায়,.. তার মুখের কথা মুখেই রইল। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। দপ করে জ্বলে উঠল। তীব্র উজ্জ্বল বৈদ্যুতিক আলো। চোখ ধাধিয়ে গেল ওদের।
খবরদার! যেখানে আছ, দাঁড়িয়ে থাক! এল কর্কশ আদেশ। অ্যারেস্ট করা হল তোমাদের!
দীর্ঘ একটা মুহূর্ত। দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগল পাঁচজনে। হঠাৎই নড়ে উঠল মরিডো। লাফ দিল সামনে। একই সঙ্গে চেঁচিয়ে উঠল, মেরিনা, ওঁদেরকে নিয়ে পালাও! ব্যাটাদের ঠেকাচ্ছি আমি!
আসুন! চেঁচিয়ে উঠল মেরিনা। জানালার দিকে ছুটেছে। আসুন আমার সঙ্গে!
পাঁই করে ঘুরেই জানালার দিকে দৌড় দিতে গেল রবিন আর কিশোর। শক্ত একটা থাবা পড়ল কিশোরের ঘাড়ে। তার শার্টের কলার চেপে ধরেছে। কিছুতেই ছাড়াতে পারল না সে।
দুপা এগোল রবিন। পরক্ষণেই পিঠের ওপর এসে পড়ল ভারি দেহ। জড়াজড়ি করতে করতে গায়ের ওপর এসে পড়েছে মরিডো আর এক প্রহরী।
ধাক্কা লেগে দড়াম করে হাত পা ছড়িয়ে আছড়ে পড়ল রবিন। জোরে ঠুকে গেল কপাল আর মাথার একটা পাশ। মেঝেতে পুরু কার্পেট না থাকলে খুলিই ফেটে যেত হয়ত। গত চব্বিশ ঘণ্টায় এই নিয়ে দুবার আঘাত পেল মাথায়।
জ্ঞান হারাল রবিন।
.
১১.
চোখ বন্ধ করে পড়ে আছে রবিন। কানে আসছে কিশোর আর মরিডোর কথা।
ওই ঝিঁঝিটার মতই জালে আটকা পড়লাম, বলল কিশোর। বাইরে করিডরে লোক থাকবে, কল্পনাও করিনি। উত্তেজনার বশে হয়ত জোরেই কথা বলে ফেলেছিলাম। কানে গিয়েছিল ব্যাটাদের। কিংবা কোন ফাঁক ফোকর দিয়ে আলোও দেখে থাকতে পারে।
আমিও কল্পনা করিনি, বিষণ্ণ কণ্ঠ মরিডোর। তাহলে ওই করিডরে আগেই একবার উঁকি দিয়ে যেতাম। যাক, মুসাকে নিয়ে মেরি অন্তত পালাতে পেরেছে।
কিন্তু ওরা দুজনে কি করতে পারবে?
জানি না। হয়ত কিছুই না। বাবা আর মিনস্ট্রেল পার্টির লোকদের জানাতে পারবে বড়জোর, আমরা ধরা পড়েছি। বাবা উদ্ধার করতে পারবে না আমাদের, তবে সময়মত লুকিয়ে পড়তে পারবে। ডিউক রোজারের হাতে পড়ে কষ্ট ভোগ করতে হবে না।
কিন্তু আমরা তিনজন পড়লাম বিপাকে! দিমিত্রিও। তিক্ত কিশোরের গলা। প্রিন্সকে সাহায্য করতে এসেছি। তা-তো করতে পারিইনি, উল্টে রোজারের পথ সাফ করে দিলাম। আমাদের কাম সারা।
কা-ম সারা!
বাংলা শব্দ। মানে, আমরা শেষ।…মনে হয়, রবিনের জ্ঞান ফিরেছে। ইসস, বেচারা নথি। দুই বার লাগল বাড়ি, দুবারই মাথায়।
চোখ মেলল রবিন। কাঠের চৌকিতে শুধু পাতলা চাদরের ওপর শুয়ে আছে চিত হয়ে। ঘরে স্লান আলো। মোমবাতিটার দিকে চেয়ে চোখ মিটমিট করল সে। পাথরের দেয়াল ঘেঁষে পাতা রয়েছে চৌকি। মাথার ওপরে পাথরের ছাত। লোহার ভারি দরজার ওপর দিকে ছোট গোল একটা ফুটো, বাইরে থেকে ঘরের ভেতরটা দেখার জন্যে।
সঙ্গীকে চোখ মেলতে দেখে কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর আর মরিডো।
উঠে বসল রবিন। এর পরে আর কখনও ভ্যারানিয়ায় এলে মাথায় হেলমেট পরে আসব, শুকনো হাসি হাসল সে।
ভালই আছেন, মনে হচ্ছে! বলল মরিডো। একটা দুশ্চিন্তা গেল।
রবিন, মনে করতে পারছ কিছু? জিজ্ঞেস করল কিশোর। ভালমত ভেবে দেখ।
নিশ্চয়। ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। ঘরে ঢুকল গার্ডের। এক ব্যাটাকে আমার ওপর ছুঁড়ে ফেললেন মরিডো। ব্যস, উপুড় হয়ে পড়ে খেলাম মাথার বাড়ি। তারপর আর কিছু মনে নেই।