একটু জিরিয়ে নিই এখানে, বলল মরিডো। এ-পর্যন্ত তো ভালই এলাম। তবে সবচেয়ে সহজ পথটা পেরিয়েছি। এইবার আসতে পারে বিপদ। আমার মনে হয়, আপনাদেরকে প্যালেসে আর খুঁজছে না ওরা এখন। তাহলে সতর্কতায় ঢিল পড়তে বাধ্য। সুযোগটা নেব আমরা। প্রথমে যাব সেই ঘরে, রূপালী মাকড়সা পাই আর না পাই। তারপর চলে যাব ডানজনে। সেখান থেকে নেমে পড়ব পাতালের ড্রেনে। মাটির তলা দিয়ে চলে যাব আমেরিকান এমব্যাসির কাছে। আপনাদেরকে। নিরাপদে পৌঁছে দিয়েই অন্য কাজে হাত দেন। পোস্টার টানাব, হরতাল করব মিনস্ট্রেলদের নিয়ে। ডিউক রোজারের শয়তানী ফাস করে দেব। জনগণকে চেতিয়ে দেবার চেষ্টা চালাব। তারপর যা থাকে কপালে, হবে। চুপ করল সে। তারপর বলল, চলুন, যাই। জানালা দিয়ে বেরিয়ে গতরাতের মত ব্যালকনিতে নামি। কার্নিস ধরে চলে যাব। সেই ঘরটায়।
দুটো দড়ি নিয়ে এসেছে ওরা। একটা মরিডোর হাতে পেঁচানো। আরেকটা মেরিনার কোমরে।
হাতের দড়িটা খুলে নিয়ে জানালার মাঝখানের দণ্ডের সঙ্গে শক্ত। করে বাঁধল মরিডো। তারপর দড়ি বেয়ে নেমে চলে গেল। কয়েক মুহূর্ত পরেই চাপা শিসের শব্দ এল ব্যালকনি থেকে। তারমানে পৌঁছে গেছে সে। ওদেরকে যাবার জন্যে ইঙ্গিত করেছে।
মুসা নেমে চলে গেল। তাকে অনুসরণ করল কিশোর।
জানালা দিয়ে বাইরে উঁকি দিল মেরিনা আর রবিন। ব্যালকনিতে আবছা আলো নড়াচড়া করছে। টর্চের মুখে হাত চাপা দিয়ে রূপালী মাকড়সা খুঁজছে তিনজনে।
খানিক পরেই নিভে গেল আলো। আবার শোনা গেল চাপা শিস।
রবিনকে দুড়ি ধরে ঝুলে পড়তে বলল মেরিনা।
ব্যালকনিতে নেমে এসেছে পাঁচজনে। দড়িটা ঝুলে আছে। থাকবে এভাবেই। রূপালী মাকড়সা খোঁজা শেষ করে আবার এপথেই ফিরে যেতে হবে। করিডর আর গোপন কিছু সিঁড়ি বেয়ে নামবে মাটির তলার ডানজনে।
মাকড়সাটা এখানে পড়েনি, অন্ধকারে ফিসফিস করে জানাল মরিডে। কণ্ঠস্বরেই বোঝা যাচ্ছে, উত্তেজিত। কে জানে, নদীতেই পড়ে গেল কিনা! তবে ঘরটা অরি কার্নিস না দেখে শিওর হওয়া যাবে না।
ব্যালকনির রেলিঙ টপকে কার্নিসে নামল ওরা। দেয়ালের দিকে মুখ করে এক সারিতে এগিয়ে চলল শামুক-গতিতে। তেমনি নিঃশব্দে।
কার্নিসটা যেখানে নব্বই ডিগ্রি কোণ করে মোড় নিয়েছে, সেখানে এসে মুহূর্তের জন্যে থমকে গেল রবিন। নিচে অন্ধকারের দিকে তাকাল! এখানে পড়ে যায়নি তো রূপালী মাকড়সা! তাহলে গেল। আর পাওয়া যাবে না ওটা। এর বেশি ভাবতে চাইল না রবিন। পাশে সরে সরে আবার এল সঙ্গীদের সঙ্গে।
কয়েক পা করে এগিয়েই টর্চ জ্বেলে দেখে নিচ্ছে মরিডো। শেষ। পর্যন্ত পৌঁছুল এসে সেই ঘরটার ব্যালকনিতে। কিন্তু পাওয়া গেল না। রূপালী মাকড়সা। শেষ ভরসা এখন, ওই ঘর। ওখানেও যদি না পাওয়া যায়, রবিনের মতই আর ভাবতে চাইল না সে-ও।
সবাই এসে উঠল ব্যালকনিতে। সাবধানে। পর্দা সরিয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি দিল মরিডো। অন্ধকার। কেউ আছে বলে মনে হল না। টর্চের আলো ফেলে নিশ্চিত হল, কেউ নেই।
একে একে ঘরে এসে ঢুকল ওরা সবাই।
এইবার খুঁজতে হবে, বলল কিশোর। কোথাও বাদ দিলে চলবে না। আনাচে-কানাচে, জিনিসপত্রের তলায়, সব জায়গায় দেখতে হবে।
হঠাৎ তীক্ষ্ণ কর্কশ একটা শব্দে চমকে উঠল সবাই। কি করে জানি ঘরে এসে ঢুকেছে একটা ঝিঁঝি পোকা।
ঘরে ঝিঁঝি ঢোকা সৌভাগ্যের লক্ষণ, ফিসফিস করে বলল মুসা। এটা আফ্রিকান প্রবাদ। প্রচুর সৌভাগ্য এখন দরকার আমাদের।
হয়েছে, বলল কিশোর। কথা না বলে এস এখন কাজ করি।
খুঁজতে শুরু করল ওরা। হাঁটু মুড়ে বসে, দরকার পড়লে উপুড় হয়ে শুয়ে, প্রতিটি বর্গ ইঞ্চি জায়গা খুঁজে দেখতে লাগল। কার্পেটের তলা, গদির নিচে দেখল আগে। তারপর দেখল খাট, আলমারি আর অন্যান্য আসবাবপত্রের তলায়। শেষে দেখল আলমারির প্রতিটি ড্রয়ার, মাকড়সাটা লুকিয়ে রাখা যেতে পারে, এমন প্রতিটি জায়গায়।
খাটের তলায় ঢুকে পড়ল রবিন। হাতে লাগল শক্ত মসৃণ কিছু। পেয়েছি! বলে চেঁচিয়ে উঠেই চুপ হয়ে গেল। প্রতিটি টর্চের আলো এসে পড়ল তার হাতের ওপর। ধাতব জিনিস। তবে রূপালী মাকড়সা নয়। অ্যালুমিনিয়ামের তৈরি। ক্যামেরার ফিল্মের কৌটার ঢাকনা।
দুত্তোর! ক্রল করে এগিয়ে গেল রবিন। উপুড় হয়ে বসে আলো ধরে রেখেছে মুসা।
ক্রিক! ক্রিক! তীক্ষ্ণ শব্দ উঠল।
আলো সরে গেল মুসার টর্চের। সবাই দেখল, ঘরের কোণের দিকে দ্রুত সরে যাচ্ছে কালো একটা পোকা। ঝিঁঝি। আলোয় অস্বস্তি বোধ। করছে। ছুটে অন্ধকারে পালাতে চাইছে।
কপাল খারাপ পোকাটার। তাড়াহুড়ো করে লাফিয়ে সরতে গিয়ে পড়ল প্রিন্স পলের মাকড়সার জালে। ছাড়া পাবার জন্যে ছটফট করতে লাগল।
দুলে উঠল জাল। সুতো বেয়ে খবর পৌঁছে গেল মাকড়সার কাছে। তক্তার প্রান্ত আর মেঝের মাঝখানে সেই ফাঁকটাতেই বসে আছে। মাকড়সা, গায়ে গা ঠেকিয়ে। দুটো। লাল বড় বড় চোখ চকচক করছে আলোয়।
দ্রুত জাল বেয়ে উঠে এল একটা মাকড়সা। তাই করে ওরা। সঙ্গীসাথী যতই থাকুক, শিকার ধরা পড়লে এক জালে একটা মাকড়সাই উঠে আসে। মুখ থেকে আঠালো সুতো বের করে পেঁচিয়ে ফেলে শিকারকে। তারপর ধীরেসুস্থে বসে আরাম করে চুষে খায় রস।
খুব বেশিক্ষণ ছটফট করতে পারল না বেচারা ঝিঁঝি। দ্রুত জড়িয়ে যেতে লাগল আঠালো সুতোয়। নড়ার ক্ষমতাই আর রইল না। সাদাটে কালো একটা গোল পুটুলি হয়ে ঝুলে রইল জালে।