বাড়ানো হাতটা ঝট করে সরিয়ে নিল মুসা। করুণ চোখে তাকাল অবশিষ্ট কয়েকটা স্যাণ্ডউইচের দিকে। মনে করিয়ে দিয়েছ, ধন্যবাদ! ঠিক আছে লাঞ্চের সময়ই না হয় আবার খাব। আসলে, জানই তো, গোটা বিশেক স্যাণ্ডউইচ খাওয়ার পরেও একটা হাঁস খেয়ে ফেলতে পারি…
এখান থেকে বেরিয়ে যেতে পারলে ডবল খেয়ে পুষিয়ে নিয়ো, বলল কিশোর। ভবিষ্যতে বেশি খাওয়ার জন্যেই এখন কম খেয়ে প্রাণটা বাঁচিয়ে রাখতে হবে তোমাকে অনেক বড় একটা দিন পুড়ে আছে সামনে।
সত্যিই, অনেক দীর্ঘ একটা দিন। সারাটা দিন শুয়ে বসেই কাটাতে হল ওদের। কখনও উঠে গিয়ে ফোকরে চোখ রাখে, ছাতে কেউ উঠে আসছে কিনা দেখে।
অবশেষে সেইন্ট ডোমিনিকসের সোনালি গম্বুজের চূড়ার কাছে নেমে গেল সূর্যটা। দুএক মুহূর্ত ঝুলে রইল যেন অনিশ্চিতভাবে, তারপর টুপ করে ডুবে গেল পাহাড়ের ওপাশে। ভেনজো নদীর তীরে ঘন গাছগাছালির ভেতর থেকে ভেসে এল ঘরেফেরা পাখির কলরব। সেটাও থেমে গেল একসময়।
রাত নামল। ঘন হল অন্ধকার। সমস্ত প্রাসাদটা নীরব নিঝুম।
রাত বাড়ল বাড়তেই থাকল। দেখা নেই মরিডোর। অস্থির হয়ে উঠছে তিন গোয়েন্দা। তবে কি সে আসবে না? কোনরকম বিপদে পড়ে গেল?
দরজা খুলল মুসা। অন্ধকার ছাত! আকাশে মেঘ জমছে। দূরে মিটমিট করছে শহরের আলো। বাতিগুলোরও ঘুম পেয়েছে যেন।
হঠাৎ ধড়াস করে উঠল হৃৎপিণ্ডটা। পাঁই করে ঘুরল মুসা। কখন নিঃশব্দে পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে ওরা, টেরই পায়নি।
সেন্ট্রিরুমের দরজা বন্ধ করে দিয়ে টর্চ জ্বাল মরিডো। ফিসফিস করে বলল, এবার বেরোতে হয়। চলুন। আমেরিকান এমব্যাসিতে যেতে হবে। পরিকল্পনা বদল করেছে ডিউক রোজার। খবর পেলাম, প্রিন্স দিমিত্রির অভিষেক অনুষ্ঠান স্থগিত ঘোষণা করবে সে আগামী কালই। নিজেকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে রিজেন্ট ঘোষণা করবে।
ঠেকানো যাবে না? জানতে চাইল কিশোর।
সম্ভব না। জনসাধারণকে যদি আসল কথাটা জানানো যেত, ছুটে আসত ওরা। ধ্বংস করে দিত রোজারকে। কিন্তু জানানো যাচ্ছে না। টেলিভিশন আর রেডিও স্টেশন দখল করে বসে আছে ডিউকের লোক। মিলিটারি দিয়ে ঘিরে রেখেছে। ওদেরকে হটানর ক্ষমতা আমাদের নেই, রবিনের দিকে ফিরল। রূপালী মাকড়সা কোথায় রেখেছেন, মনে পড়েছে? আঙিনায় পাওয়া যায়নি ওটা।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রবিন। মাথার চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে।
মাকড়সাটা যদি পাওয়া যায়, বলে উঠল কিশোর, কি লাভ হবে? রোজারকে ঠেকানো যাবে এখন?
হয়ত, কথা বলল মেরিনা। মিনস্ট্রেলরা গোপনে একটা সভা ডাকতে পারবে। পাড়ার মাতব্বর গোছের কিছু কিছু লোককে ডেকে আনা হবে। মাকড়সাটা দেখিয়ে বলতে পারবে প্রিন্স দিমিত্রি সাহায্য চান। আমাদের হাতের রূপালী মাকড়সা দেখলে অবিশ্বাস করবে না তারা। খবরটা ছড়িয়ে পড়বে। এতে হয়ত স্রোতের মোড় ঘুরেও যেতে পারে। শুধু ডেনজো শহরের লোক খেপে উঠলেই রোজারের বারোটা বাজবে।
তাহলে, জোর দিয়ে বলল কিশোর। মাকড়সাটা খুঁজে বের করতেই হবে আমাদের। এবং সেটা এই প্রাসাদ ছাড়ার আগেই। ব্যালকনি, কার্নিস সব খুঁজব। শেষে ঢুকব সেই ঘরে। রূপালী মাকড়সানা নিয়ে যাব না।
বুঝতে পারছেন, কি ভয়ানক ঝুঁকি নিতে যাচ্ছেন? হুশিয়ার করল মরিডো।
পারছি, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। তবে, বিপদে না-ও পড়তে পারি। ওই ঘরে আবার ফিরে যাব আমরা, ভাববে না কেউ।…অন্তত, সে-সম্ভাবনা কম…
.
১০.
সেন্ট্রিরুম ছাড়ার আগে প্রতিটি সম্ভাবনার ব্যাপারে আলোচনা করল ওরা। এখানে ঢুকেছিল, এটা যাতে কেউ বুঝতে না পারে, সে ব্যাপারেও খুব সতর্ক হল। পড়ে থাকা খাবারের প্রতিটি কণা তুলে নিল, ফেলে দিল ফোকর দিয়ে ডেনজো নদীতে। প্যাকেটের কাগজটা দলে মুচড়ে বল বানিয়ে ফেলে দিল। মোট কথা, কোনরকম চিহ্নই রাখল না।
রাত আরও বাড়ার অপেক্ষায় রইল ওরা, পাহারাদারদেরকে ঝিমিয়ে পড়ার সময় দিল।
অনেক অপেক্ষা করেছি, একসময় বলে উঠল মরিডো। দুটো বাড়তি টর্চ এনেছি, এই যে, পকেট থেকে ছোট দুটো টর্চ বের করে মুসা আর কিশোরের হাতে তুলে দিল। নিতান্ত দরকার না হলে জ্বালবেন না। গতরাতের মতই আমি আগে থাকব, মেরি সবার পেছনে। ঠিক আছে?
নীরবে মাথা কাত করে সমর্থন জানাল তিন গোয়েন্দা।
এক সারিতে সেন্ট্রিরুম থেকে বেরিয়ে এল ওরা। একটাও তারা নেই আকাশে, ঢেকে গেছে কালো মেঘে। ওরা বেরোতে না বেরোতেই একটা দুটো করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল, বড় বড়।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে এল ওরা। পাঁচতলার করিডরে নেমে থামল। কালি গুলে দিয়েছে যেন কেউ। আধ হাত দূরের জিনিস দেখা যায় না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল পুরো একটা মিনিট। না, কোন শব্দ কানে আসছে না। মরে গেছে যেন বিশাল প্রাসাদটা।
ঝুঁকি নিতেই হল। টর্চ জ্বালল মরিডো, অন্ধকারে এগোতে পারবে না নইলে। একবার জেলেই নিভিয়ে দিল আবার। পথ দেখে নিয়ে পা বাঁড়াল।
অন্ধকারে এগিয়ে চলেছে ওরা। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে পথ দেখে নিচ্ছে মরিডো।
পেরিয়ে এল অসংখ্য করিডর, সিঁড়ি। ছেড়ে দিলে বলতেই পারবে না তিন গোয়েন্দা, কোন্ পথে এসেছে। পথ চিনে ফিরে যেতে পারবে কিনা সন্দেহ। মস্ত এক গোলক ধাঁধা যেন!
তবে মরিডো চেনে পথ। একটা ঘরে এসে ঢুকল সবাইকে নিয়ে ছিটকিনি তুলে দিল দরজায়।