এই, চুপ! চাপা গলায় হুঁশিয়ার করল মুসা। একটা লোক! এদিকেই আসছে!
দ্রুতপায়ে ফোকরের কাছে এসে দাঁড়াল অন্য দুজন।
ঢোলাঢালা ধূসর রঙের পোশাক পরনে। সামনের দিকে লম্বা। অ্যাপ্রন। হাতে ঝাড়, বালতি আর ন্যাকড়া। কয়েক পা এগিয়েই হাতের জিনিসগুলো নামিয়ে রাখল লোকটা। ভুরু কুঁচকে তাকাল একবার সেন্ট্রিরুমের দিকে। পেছনে সিঁড়ির দিকে তাকাল। তারপর এগিয়ে এল। পায়ে পায়ে।
টোকা পড়ল দরজায়। আস্তে করে।
মুসা, দরজাটা খুলে দাওঁ, ফিসফিস করে বলল কিশোর। গার্ড নয়। ও জানে, আমরা আছি এর ভেতর।
ছিটকিনি খুলে দিয়েই এক লাফে পাশে সরে গেল মুসা। তৈরি। যদি তেমনি বোঝে, লাফিয়ে পড়বে লোকটার ঘাড়ে। তিনজনে মিলে কাবু করে ফেলতে পারবে।
আস্তে ঠেলা দিয়ে দরজা খুলল লোকটা। চট করে ঢুকেই ঠেলে বন্ধ করে দিল আবার পাল্লা। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর গিয়ে দাঁড়াল একটা ফোকরের কাছে। সিঁড়ির দিকে চেয়ে বলল, কেউ পিছু লেগেছে কিনা, দেখছি! হুঁশিয়ার থাকা ভাল।
দুটো মিনিট চুপচাপ ফোকরের কাছে দাঁড়িয়ে রইল ওরা। দৃষ্টি সিঁড়ি আর ছাতের দিকে।
না, ফেউ লাগেনি পেছনে, অবশেষে বলল লোকটা। আমি ঝাড়দার। এক ফাঁকে উঠে চলে এসেছি। দেখেনি কেউ। মরিডোর মেসেজ আছে। জানতে চেয়েছে: রবিনের মনে পড়েছে কিনা।
না, জবাব দিল কিশোর। মরিডোকে বলবে, মনে পড়েনি।
বলব। অধৈর্য হতে মানা করেছে মরিডো। আঁধার নামলেই আসবে সে। এই যে নিন, খাবার। অ্যাপ্রনের পকেট থেকে একটা অয়েল-পেপারের প্যাকেট বের করে দিল লোকটা। আরেক পকেট থেকে একটা প্লাস্টিকের বোতল বের করল। আর এই যে, পানি।
খাবারের প্যাকেট আর বোতল হাতে নিল মুসা।
আমি যাই, বলল লোকটা। নিচের অবস্থা খুব খারাপ। ধৈর্য হারাবেন না, সাহেবরা। প্রিন্স পল রক্ষা করবেন আপনাদের। তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে চলে গেল ঝাড়দার।
দরজার ছিটকিনি তুলে দিল কিশোর।
ইতিমধ্যে খাবারের প্যাকেট অর্ধেক খুলে ফেলেছে মুসা। স্যাণ্ডউইচ, আর কিছু ফল। হাসি একান ওকান হয়ে গেল তার। আর দেরি করে লাভ কি? এস শুরু করে দিই। একটা স্যাণ্ডউইচ নিয়ে প্যাকেটটা বেঞ্চে নামিয়ে রাখল। কামড় বসাল খাবারে।
রেখে রেখে খেতে হবে, একটা স্যাণ্ডউইচ তুলে রবিনের দিকে বাড়িয়ে ধরল কিশোর। এই খাবার আর পানি দিয়েই চালাতে হবে সারাটা দিন। প্রাসাদে মরিডোর লোক না থাকলেই মরেছিলাম!
হ্যাঁ, স্যাণ্ডউইচ চিবোতে চিবোতে বলল রবিন। আচ্ছা, গতরাতে প্রিন্স দিমিত্রি আর মিনস্ট্রেল পার্টি নিয়ে কি যেন আলাপ করছিলে মরিডোর সঙ্গে। মাথার ব্যথায় ভালমত কান দিতে পারিনি।
কিছু কিছু কথা তো দিনেই শুনেছ, বলল কিশোর। দিমিত্রির বাবার রাজত্বকালে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মরিডোর বাবা। ডিউক রোজার রিজেন্ট হয়েই তাঁকে চেয়ার ছাড়তে বাধ্য করল। তখন থেকেই রোজারের ওপর সন্দেহ মিনস্ট্রেলদের। ওরা বুঝে ফেলল, দিমিত্রিকে সহজে প্রিন্স হতে দেবে না ডিউক। কাজে নেমে পড়ল ওরা। গোপনে। একটা দল গঠন করল। প্রিন্স পলের নাম করে শপথ নিল, নিজেদের প্রাণের বিনিময়ে হলেও, রোজারের পরিকল্পনা সফল হতে দেবে না। গার্ড, অফিসার এমনকি চাকর-বাকর, ঝাড়দারদের মাঝেও লোক আছে তাদের। গতরাতে, আমাদেরকে গ্রেফতার করার আদেশ দিয়েছিল রোজার। সেটা জেনে ফেলেছিল একজন গার্ড, মিনস্ট্রেল পার্টির লোক। সঙ্গে সঙ্গে মরিডোকে জানিয়েছে সে ব্যাপারটা। এক বিন্দু দেরি করেনি মরিডো আর মেরিনা। ছুটে চলে এসেছে। নইলে তো গিয়েছিলাম ধরা পড়ে… স্যাণ্ডউইচে কামড় বসাল কিশোর। চিবিয়ে গিলে নিয়ে বলল, ছোট বেলায় প্যালেসে প্রায়ই আসত মেরিনা আর মরিডো। কোথাও ঢোকা বারণ ছিল না ওদের। ফলে এই প্রাসাদের গলি ঘুপচি প্রায় সবই ওদের চেনা। গোপন কোন পথ দিয়ে গিয়ে কোন্ সুড়ঙ্গে, ঢোকা যায়, সেখান থেকে নেমে যাওয়া যায় বিশাল নর্দমায়, জানে ওরা। গার্ডদেরও। অনেকেই চেনে না ওই পথ। ওদের চোখ এড়িয়ে তাই সহজেই প্রাসাদে ঢুকে পড়তে পারে দুই ভাইবোন, বেরিয়ে যেতে পারে।
খুব ভাল, বলে উঠল মুসা। তবে আমরা আটকে আছি ছাতে, এটা আবার খুব খারাপ কথা। তোমার কি মনে হয়? গার্ডদের চোখ এড়িয়ে আজ রাতে আসতে পারবে ওরা? বের করে নিয়ে যেতে পারবে আমাদের?
মনে তো হয়, বলল কিশোর। তার আগেই যদি অবশ্য ধরা না পড়ে যাই। এখান থেকে বেরিয়েই সোজা আমেরিকান এমব্যাসিতে চলে যেতে হবে আমাদের। ক্যাসেটটা তুলে দিতে হবে ওদের হাতে। রোজারের বিরুদ্ধে এটা একটা সাংঘাতিক প্রমাণ।
জেমস বৎ হলে নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম এখন, হাতের অবশিষ্ট স্যাণ্ডউইচটুকু মুখে পুরে দিল মুসা। দুই চিবান দিয়েই গিলে ফেলল কোঁৎ করে। জেমস বণ্ডের একটা সুবিধে আছে। যে বিপদেই পড়ুক না কেন, ঠিক বেরিয়ে যায়। তারজন্যে বিপদে পড়া আর না পড়া সমান কথা। কিন্তু আমাদের? নিজেরা কিছুই করতে পারছি না। অন্যের ওপর নির্ভর করে হাঁ হয়ে বসে থাকতে হবে সারাটা দিন!
আমাদের সাধ্যমত আমরা করেছি, করব, দৃঢ়কণ্ঠে বলল কিশোর। এখান থেকে বেরিয়ে যাব, প্রিন্স দিমিত্রিকে সাহায্যও করব। সহজে হাল ছাড়ছি না। তবে, মরিডো আর মেরিনা আসার আগে হাঁ করেই বসে থাকতে হবে আমাদের, এতে কোন সন্দেহ। নেই।…সেকেণ্ড, নাস্তা-লাঞ্চ সব একবারেই সেরে ফেলবে নাকি?