সর্বনাশ করেছি তাহলে! বলে উঠল রবিন। গলা কাঁপছে। ঢোক মিলল। কিশোর, মুসা, আমার পকেট খুঁজে দেখ।
তন্ন তন্ন করে রবিনের সব পকেট খুঁজল মুসা আর কিশোর, টেনে উল্টে বের করে আনল পকেটের কাপড় নেই! জামার হাতার ভাঁজ, প্যান্টের নিচের ভাজ, জুতো-মোজার ভেতর, কোথাও খোঁজা বাদ রাখল না। নেই তো নেই-ই। পাওয়া গেল না রূপালী মাকড়সা।
ভাব, রবিন, অবশেষে বলল কিশোর। ভাল করে ভেবে দেখ, কোথায় রেখেছিলে! তোমার হাতে ছিল ওটা, তারপর কি করলে?
মনে করার চেষ্টা করল রবিন। জানি না! হতাশ কণ্ঠ। রুমালের ভাঁজ থেকে পড়ে গিয়েছিল মেঝেতে। হাতে তুলে নিলাম। দরজায় ধাক্কা দেবার শব্দ হল। জানালা দিয়ে লাফিয়ে এসে পড়ল মরিডো। তারপর আর কিছু মনে নেই!
হুমম! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। অ্যামনেশিয়া, আংশিক! মাথায় আঘাত পেলে মাঝেসাঝে ঘটে এটা। বিস্মরণ ঘটে। অতীত জীবনের সমস্ত স্মৃতি হারিয়ে যায় কারও, কেউ হারায় কয়েক হপ্তা, কেউ কয়েক দিন। কয়েক মিনিট হারিয়ে ফেলার ঘটনাও ঘটেছে অনেক। রবিনেরটা কয়েক মিনিট। কারও কারও বেলায় ঠিক হয়ে যায় এটা, আবার ফিরে পায় ওই স্মৃতি। ওর বেলায় কি ঘটবে, জানি না। মাথায় আঘাত লাগার তিন চার মিনিট আগের সমস্ত ঘটনা মুছে গেছে তার মন থেকে।
মনে হয় ঠিকই বলেছ, বলল রবিন। হয়ত তা-ই ঘটেছে। আহত জায়গায় হাত চলে গেল। খুব আবছাভাবে মনে পড়ছে এখন, সারা ঘরে ছুটোছুটি করছিলাম। মাকড়সাটা লুকানর জায়গা খুঁজছিলাম। উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলাম খুব। কার্পেটের তলায়, গদির তলায়, কিংবা আলমারিতে ঢুকিয়ে রাখার কথা মনে এসেছিল। তবে ওসব জায়গা নিরাপদ বলে মনে হয়নি…
চুপ করল রবিন।
অন্যরাও চুপ করে রইল কয়েক মুহূর্ত। এরপর কি করেছে, মনে করার সুযোগ দিল রবিনকে। কিন্তু আর কিছু মনে করতে পারল না সে।
আমাকে দেখার পর একটা কাজ করাই সবচেয়ে স্বাভাবিক, বলল মরিডো। পকেটে ঢুকিয়ে ফেলা। হয়ত তাই করেছেন। তবে ভালমত রাখতে পারেননি তাড়াহুড়ায়। তারপর, যখন কার্নিসে উঠলেন, কোনভাবে পড়ে গেছে মাকড়সাটা। ব্যালকনিতে যখন আছড়ে পড়েছেন, তখনও পড়ে গিয়ে থাকতে পারে।
কিংবা হয়ত আমার হাতেই ছিল, পকেটে ঢোকাইনি, বলল রবিন। কোন এক সময় হাত থেকে ছুটে পড়ে গেছে। কার্নিস কিংবা ব্যালকনিতে পড়ে থাকার আশা খুবই কম, তবে সম্ভবত নিচে, আঙিনায় পড়েছে।
আঙিনায় পড়ে থাকলে পাওয়া যাবে, বলল মরিডো। ব্যালকনি কিংবা কার্নিসে থাকলেও পেয়ে যাব! কিন্তু, যদি পাওয়া না যায়… চুপ করে গেল সে।
কিংবা ঘরেও ফেলে এসে থাকতে পারেন, এতক্ষণে কথা বলল মেরিনা। হয়ত খোঁজার কথা ভাবেই না গার্ডেরা। ধরেই নেবে, আপনারা সঙ্গে নিয়ে গেছেন। যদি আঙিনায় পাওয়া না যায়, আগামীকাল রাতে আবার সে ঘরে ফিরে যাব আমরা। খুঁজব। কার্নিস আর ব্যালকনিও বাদ দেব না।
০৯.
সারাটা রাত ওই সেন্ট্রিরুমেই কাটিয়ে দিয়েছে তিন গোয়েন্দা।
ছাতে কেউ খুঁজতে আসেনি তাদেরকে। বেশ ভালই বুদ্ধি করেছিল মরিডো। ব্যালকনি থেকে ঝোলানো দড়ি, একটা ডানজনের দরজায়। পড়ে থাকা কিশোরের রুমাল (পরে জেনেছে তিন গোয়েন্দা) অন্যদিকে চোখ সরিয়ে রেখেছে পাহারাদারদের। হাতে খোঁজার কথা ভাবেইনি কেউ।
আরও কিছুক্ষণ কথা বলে চলে গিয়েছিল মরিডো আর মেরিনী। তারপর লম্বা হয়ে কাঠের বেঞ্চেই শুয়ে পড়েছে তিন কিশোর। সারাদিন প্রচণ্ড পরিশ্রম আর উত্তেজনার মাঝে কেটেছে, শক্ত কাঠের ওপর শুয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল। রূপালী মাকড়সা
পরদিন সূর্য ওঠার পর ভাঙল ঘুম।
চোখ মেলল মুসা। বড় করে হাই তুলল, আড়মোড়া ভাঙল। পাশে চেয়ে দেখল, আগেই উঠে পড়েছে কিশোর। হালকা ব্যায়াম করছে। মাংসপেশীর জড়তা দূর করার জন্যে।
উঠে বসল মুসা। জুতো গলাল পায়ে। দাঁড়াল। এখনও ঘুমিয়ে আছে রবিন।
সকালটা বেশ সুন্দর, দেয়ালের ফোকর দিয়ে বাইরে উঁকি দিয়ে বলল মুসা। দিনটা ভালই যাবে, তবে আমাদের জন্যে না। পেটের ভেতর ছুঁচো নাচানাচি করছে। অথচ কোন খাবার নেই, নাস্তাই নেই, লাঞ্চ আর ডিনার তো স্বপ্ন! কিশোর, খাওয়া-টাওয়া পাব কিছু?
দুত্তোর তোমার খাওয়া! ঝাঁঝালো কণ্ঠ কিশোরের। কি করে বেরোব এই মৃত্যুপুরী থেকে তাই জানি না, খাওয়া! মরিডো কি করছে না করছে, রাতেও আসতে পারবে কিনা, তাই বা কে জানে!
সত্যিই বেরোতে পারব না আমরা এখান থেকে! চুপসে গেছে মুসা। তাহলে আর জীবনেও কিছু খাওয়া হবে না! হতাশ ভঙ্গিতে এদিক ওদিক মাথা নাড়ল সে। আচ্ছা, কিশোর, তোমার কি মনে হয়? জেগে উঠলে মনে করতে পারবে রবিন? রূপালী মাকড়সা কোথায় রেখেছে, বলতে পারবে?
কিশোর কোন জবাব দেবার আগেই চোখ মেলল রবিন। মিটমিট করে বন্ধ করল, তারপর আবার খুলল। আমরা কোথায়? বলতে বলতেই হাত নিয়ে গেল মাথার পেছনে, আহত জায়গায়। ইহ্! ব্যথা…! হ্যাঁ, এই বার মনে পড়েছে…
কি, কি মনে পড়েছে? লাফ দিয়ে দেয়ালের কাছ থেকে সরে এল মুসা। রূপালী মাকড়সা কোথায়, মনে পড়েছে?
মাথা নাড়ল রবিন। এখানে কি করে এলাম, সেটা মনে পড়েছে।
অ-অ! আবার হতাশ হয়ে পড়ল মুসা। আবার চলে গেল ফোকরের কাছে।
ভেব না, রবিন, আশ্বাস দিল কিশোর। সময় যাক। তোমার মাথার যন্ত্রণা যাক। তারপর হয়ত মনে পড়ে যাবে সব কথা…