নতুন চোখে রাজকুমারের দিকে তাকাল তিন গোয়েন্দা। না, যা ভেবেছিল, তা নয়। অনেক বেশি বুদ্ধিমান। দিমিত্রির প্রতি শ্রদ্ধা বাড়ল ওদের।
পকেট থেকে কার্ড বের করল দিমিত্রি। বাড়িয়ে দিল তিন। গোয়েন্দার দিকে। এটা আমার কার্ড।
কার্ডটা নিল কিশোর। দুপাশ থেকে তার গা ঘেঁষে এল রবিন আর মুসা, দেখার জন্যে। ধবধবে সাদা, চকচকে মসৃণ কার্ডটায় কালো কালিতে ছাপা: দিমিত্রি দামিয়ানি। নামের ওপরে একটা ছবি, উজ্জ্বল রঙে ছাপা। সোনালি জালের মাঝখানে বসে আছে একটা রূপালী মাকড়সা, এক পায়ে ধরে রেখেছে তলোয়ার। ছোট্ট ছবিতে এতগুলো ব্যাপার নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা খুব মুশকিল, তবু যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে শিল্পী।
রূপালী মাকড়সা, বলল রাজকুমার। আমার, মানে ভ্যারানিয়ান রাজবংশেরই প্রতীক চিহ্ন এটা। নিশ্চয় অবাক হচ্ছ, একটা মাড়সা কি করে এত সম্মান পায়? সে অনেক লম্বা চওড়া কাহিনী, এখন বলার সময় নেই। একে একে তিন গোয়েন্দার সঙ্গে হাত মেলাল দিমিত্রি। তোমাদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুব খুশি হয়েছি।
লিমোসিনের পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে একটা কালো গাড়ি, প্রায় নিঃশব্দে। উত্তেজনা আর গোলমালে খেয়ালই করেনি তিন গোয়েন্দা। ওটা থেকে নামল এক তরুণ। হালকা-পাতলা, সুন্দর চেহারা। চোখে সদাসতর্কতা। ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল সে। এতক্ষণে দেখতে পেল তিন। গোয়েন্দা আমেরিকান যুবককে।
মাফ করবেন, ইয়োর হাইনেস, বলল যুবক। দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাদের। এখনও অনেক কিছুই দেখা বাকি।
হোক বাকি, বলল দিমিত্রি। এদের সঙ্গে কথা বলতেই বেশি ভাল লাগছে আমার। এই প্রথম আমেরিকান ছেলেদের সঙ্গে কথা বলার। সুযোগ পেয়েছি।
তিন গোয়েন্দার দিকে ফিরল আবার রাজকুমার। আচ্ছা, শুনেছি, ডিজনিল্যাণ্ড নাকি এক আজব জায়গা! দেখার অনেক কিছু আছে। ওখানে যাবার খুব ইচ্ছে আমার। তোমরা কি বল?
ডিজনিল্যাণ্ড সত্যিই একটা দেখার মত জায়গা, একবাক্যে স্বীকার করল তিন গোয়েন্দা। ওটা না দেখলে মস্ত ভুল করবে দিমিত্রি এটাও জানাল।
বডিগার্ডের সারাক্ষণ ঘিরে আছে, মোটেই ভাল লাগে না আমার, বলল রাজকুমার। খুব বেশি বাড়াবাড়ি করে ডিউক রোজার, আমার গার্জেন, ভ্যারানিয়ার রিজেন্ট এখন। আমাকে চোখে চোখে রাখার নির্দেশ দিয়ে দিয়েছে গার্ডদের। যেন, অন্য কেউ আমার কাছে ঘেষলেই সর্দি লেগে মরে যাব! যত্তসব!…লোকের যেন আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই, খালি আমাকে মারার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে! ভ্যারানিয়ার কোন শত্রু নেই, তারমানে আমারও নেই। কে আমাকে মারতে আসবে? খামোকা ঝামেলা!
ক্ষোভ প্রকাশ করতে গিয়ে অনেক কথা বলে ফেলল দিমিত্রি। চুপ করে গেল হঠাৎ। নীরবে দেখল তিন গোয়েন্দাকে। এক মুহূর্ত ভাবল কি যেন! তারপর বলল, তোমরা ডিজনিল্যাণ্ড যাবে আমার সঙ্গে? তোমাদের তো সব চেনা, দেখাবে আমাকে? খুব খুশি হব। বডিগার্ডের বদলে বন্ধুরা সঙ্গে থাকলে দেখেও মজা পাব অনেক বেশি। চল না!
দিমিত্রির হঠাৎ এই অনুরোধে অবাক হল তিন গোয়েন্দা। দ্রুত আলোচনা করে নিল নিজেদের মাঝে। সারাটা দিন পড়ে আছে সামনে, কিছুই করার নেই তেমন। দিমিত্রির অনুরোধ রক্ষা করা যায় সহজেই। বরং ভালই লাগবে ওদের।
রোলস রয়েসে টেলিফোন রয়েছে। স্যালভেজ ইয়ার্ডে মেরিচাচীকে ফোন করল কিশোর। জানাল, ওর ফিরতে দেরি হবে। সোনালি রিসিভারটা ক্রেডলে রেখে ফিরে চাইল। অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। দিমিত্রি।
লিমোসিনে গিয়ে উঠে বসল দিমিত্রি। বন্ধুদের ডাকল।
রাজকুমারের গাড়িতেই যেতে পারবে তিন গোয়েন্দা। হ্যানসনকে রোলস রয়েস নিয়ে চলে যেতে বলল কিশোর। তারপর গিয়ে উঠে বসল। লিমোসিনে। মুসা আর রবিনও উঠল। সামনে শোফারের পাশে বসেছে
লম্বা লোকটা।– কালো গাড়িটায় উঠল অন্যরা। গাদাগাদি ঠাসাঠাসি করে বসতে হল। গাড়িটা আমেরিকান সরকারের। প্রিন্সের গাড়িকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাবার জন্যে সঙ্গে দেয়া হয়েছে।
খুব রাগ করবেন ডিউক রোজার, মুখ গোমড়া করে রেখেছে লম্বা লোকটা। ঝুঁকি নিতে নিষেধ করেছেন তিনি।
কোন ঝুঁকি নিইনি, লুথার, কড়া গলায় বলল দিমিত্রি। তাছাড়া ডিউক রোজারের আদেশ মানতে আমি বাধ্য নই। আমার আদেশ মেনে। চলার সময় এসে গেছে তার। আর মাস দুয়েক পরই রাজ্য শাসন করব আমি। আমার কথাই তখন আইন, তার নয়। শোফারকে বলল, রিগো, খুব সাবধানে চালাবে। এটা তোমার ভ্যারানিয়া নয়, যে প্রিন্সের গাড়ি দেখলেই রাস্তা ছেড়ে দেবে লোকে। ট্রাফিক আইন মেনে চলবে পুরোপুরি। আর কোনরকম অঘটন চাই না আমি!
বিদেশী ভাষায় একনাগাড়ে কথা বলে গেল ডিউক লুথার। মুখচোখ কালো। মাথা ঝোঁকাল শোফার। গাড়ি ছেড়ে দিল।
মসৃণ গতিতে এগিয়ে চলেছে লিমোসিন, গতি মাঝারি। কোনরকম গোলমাল করল না আর শোফার। ঠিকঠাক মেনে চলল সব ট্রাফিক আইন। খুব সর্তক।
পঁয়তাল্লিশ মিনিট লাগল ডিজনিল্যাণ্ডে পৌঁছাতে। সারাটা পথ তিন গোয়েন্দাকে প্রশ্নের পর প্রশ্ন করে এসেছে দিমিত্রি। আমেরিকা, বিশেষ করে ক্যালিফোর্নিয়া সম্পর্কে জেনেছে অনেক কিছু। কখনও বাংলাদেশে আসেনি রাজকুমার। প্রায় কিছুই জানে না দেশটা সম্পর্কে। কিশোরের কাছে জানল অনেক কিছু। মুগ্ধ হয়ে গেল রাজকুমার। বলল, সুযোগ আর সময় পেলেই বাংলাদেশে ঘুরে যাবে সে। দেখবে ধানের খেত, মেঘনার চর, পদ্মার ঢেউ…শুনবে সন্ধ্যায় চৈতী শালিকের কিচির মিচির, বাঁশ বনের ছায়ায় দোয়েলের শিস, চাঁদনী রাতে শেয়ালের হুক্কাহুয়া…