টর্চ জ্বেলে দেখে নিল মরিডো। দেয়ালের গায়ে একটা দরজার সামনে এসে থামল। ধাক্কা দিল খুলল না। আরও জোরে ধাক্কা দিতেই মরচে পড়া কজা তীক্ষ্ণ আর্তনাদ করে উঠল। খুলে গেল পাল্লা। চমকে উঠল সবাই।
কান খাড়া করে দুরুদুরু বুকে দাঁড়িয়ে রইল ওরা এক মুহূর্ত। না, কোনরকম শব্দ শোনা গেল না। ভেতরে পা রাখল ওরা। একটা সিঁড়ি ঘর।
অন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। সামনে আরেকটা। ধাক্কা দিয়ে দরজা খুলে ফেলল মরিডো।
খোলা ছাতে বেরিয়ে এল ওরা। ছাত ঘিরে রেখেছে উঁচু দেয়াল। দেয়ালের গায়ে মাঝে মাঝে বড় কুলুঙ্গিমত রয়েছে।
ওখান থেকে তীর ছোঁড়া হত, গরম তেল ঢেলে দেয়া হত শত্রুর ওপর, কুলুঙ্গিগুলো দেখিয়ে বলল মরিডো। আজকাল আর ওসবের দরকার হয় না। ছাতে পাহারাই থাকে না অনেক বছর ধরে।
প্রত্যেক কোনায় সেন্ট্রিরুম রয়েছে। এক কোণে পাথরের একটা খুপরিমত ঘরে নিয়ে এল ওদেরকে মরিডো। অনেক আপত্তি প্রকাশ করার পর খুলে গেল কাঠের দরজা। ভেতরে আলো ফেলল সে। চার দেয়াল ঘেঁষে চারটে লম্বা বেঞ্চ, ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে ওখানেই শুয়ে ধুমাত সেন্ট্রিরা। ধুলোয় একাকার। ছোট ছোট ফোকর রয়েছে দেয়ালে, কাঁচ নেই।
এককালে সারাক্ষণ পাহারা থাকত এখানে, বলল মরিডো। সে অনেক আগের কথা। এখানে আপাতত নিরাপদ আপনারা। আগামীকাল রাতে আবার আসব। যদি পারি।
ধপ করে একটা কাঠের বেঞ্চে বসে পড়ল কিশোর। কপাল ভাল, এখন গরমকাল। নইলে ঠাণ্ডায় জমেই মরতে হত।…তো, এসব কি? কি ঘটেছিল?
কোন ধরনের ফাঁদ, বলল মেরিনা। রূপালী মাকড়সা চুরির অজুহাতে আপনাদেরকে গ্রেফতার করা হত। তারপর, কোন একটা কায়দা বের করে সিংহাসনে বসতে দিত না প্রিন্স দিমিত্রিকে। এখন পর্যন্ত এইই জানি।
আমরা চুরি করিনি রূপালী মাকড়সা, বলল কিশোর।
জানি।
কিন্তু ওটা এখন আমাদের কাছেই আছে। রবিন, দেখাও ওদের।
জ্যাকেটের এক পকেটে হাত ঢোকাল রবিন। তারপর ঢোকাল। অন্য পকেটে। সতর্ক হয়ে উঠল। তাড়াতাড়ি খুঁজল সবকটা পকেট। ঢোক গিলল। কিশোর…নেই…! নিশ্চয় পড়ে গেছে কোথাও
.
০৮.
মাকড়সাটা ছিল আপনার কাছে? হারিয়েছেন? আতঙ্কিত গলা মরিডোর।
সর্বনাশ! বলে উঠল মেরিনা। আপনাদের কাছে এল কি করে? হারালই বা কি করে?
ভল্ট থেকে রূপালী মাকড়সা চুরি যাওয়ার কাহিনী খুলে বলল কিশোর, যা যা শুনেছিল প্রিন্স দিমিত্রির কাছে। জানাল, আসলটার জায়গায় নকলটা পড়ে আছে এখন। প্রিন্সের সন্দেহ, চুরি করেছে ডিউক রোজার, দিমিত্রির প্রিন্স হওয়া ঠেকানর জন্যে।
রবিন জানাল, ড্রয়ারে রুমালের আজ থেকে কি করে পেয়েছে সে মাকড়সাটা।
ষড়যন্ত্রটা বুঝতে পারছি এবার, চিন্তিত শোনাল মরিডোর গলা। ডিউক রোজারই মাকড়সাটা আপনাদের ঘরে লুকিয়ে রেখেছিল। তারপর লোক পাঠিয়েছে গ্রেফতার করতে। মাকড়সাটা পাওয়া যেত আপনাদের ঘরে। প্রিন্স দিমিত্রির অসাবধানতার কারণেই ওটা চুরি। করতে পেরেছেন, ঘোষণা করে দিত ডিউক। প্রিন্সের ওপর বিশ্বাস হারাত লোকে। আপনাদেরকে ভ্যারানিয়া থেকে বের করে দিত রোজার, আমেরিকার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করত। রাজ্যশাসন চালিয়ে যেত! তারপর কোন এক সময়ে নিজেকে স্থায়ী রিজেন্ট ঘোষণা করে বসে পড়ত সিংহাসনে।
কিন্তু মাকড়সাটা এখন তার হাতে নেই, বলল মুসা। আর তো এগোতে পারছে না।
পারছে, বলল মরিডো। আপনাদেরকে ধরার চেষ্টা করবে। ধরতে পারলেই ঘোষণা করবে, মাকড়সাটা কোথাও লুকিয়ে ফেলেছেন। আপনারা। আমেরিকান এমব্যাসিতে পালিয়ে যেতে পারলেও বদনাম থেকে রেহাই পাবেন না। তাহলে বলবে, রূপালী মাকড়সা চুরি করে নিয়ে চলে গেছেন আপনারা।
কিন্তু একটা ব্যাপার এখনও বুঝতে পারছি না, বলল মুসা। রূপালী মাকড়সা হারালে কিংবা চুরি গেলে, দিমিত্রির দোষটা কোথায়? আমরা না এলেও তো ওটা চুরি যেতে পারত? আগুন লেগে কিংবা অন্য কোন কারণে নষ্ট হয়ে যেতে পারত। তখন?
তখন সারা দেশ শোক প্রকাশ করত দীর্ঘদিন ধরে। প্রিন্স দিমিত্রির কোন দোষ থাকত না। এখন তো বলবে, আমেরিকান কয়েকটা চোর বন্ধুকে এনে ভল্টে ঢুকিয়েছে, ফলে চুরি গেছে মাকড়সা। আসলে, প্রিন্স পল আমাদের কাছে কতখানি কি, সেটা বলে বোঝানো যাবে না আপনাদের। তারই প্রতীকচিহ্ন ওই রূপালী মাকড়সা। ওটার ওপরই নির্ভর করছে আমাদের ভাগ্য, স্বাধীনতা, ভবিষ্যৎ।
চুপ করে রইল তিন গোয়েন্দা।
হয়ত বলবেন আমরা কুসংস্কারে বেশি বিশ্বাসী, আবার বলল মরিডো। কিন্তু আজ পর্যন্ত মাকড়সার অবমাননা করে টিকতে পারেনি কেউ, ধ্বংস হয়ে গেছে। বংশ বংশ ধরে প্রিন্স পলকে ভালবেসে এসেছি আমরা। তাঁর আদেশ, তাঁর নির্দেশ এখনও ভ্যারানিয়ানদের কাছে ধ্রুববাক্য। আমরা জানি, যতদিন রূপালী মাকড়সা নিরাপদে থাকবে, ভ্যারানিয়ানরা নিরাপদ। ওটার কোন ক্ষতি হলেই অভিশাপ নেমে আসবে আমাদের ওপর। ওটা রক্ষা করার জন্যে প্রাণ দিতেও আপত্তি নেই আমাদের সরাসরি না হলেও প্রিন্স দিমিত্রি এটা হারানর ব্যাপারে জড়িত, দেশের লোক তাই জানবে। মন থেকে কোনদিনই আর তাকে ভালবাসতে পারবে না। সিংহাসনে বসার অযোগ্য মনে করবে। থামল। একটু। ভাবল। তারপর বলল, তাহলে বুঝতেই পারছেন রূপালী মাকড়সা খুঁজে পেতেই হবে আমাদের। নইলে ডিউক রোজারেরই জিত।