রবিন! কানের কাছে ডাক শুনে চোখ মেলল সে।
রবিন! শুনতে পাচ্ছেন! লেগেছে কোথাও! শঙ্কিত গলা মরিডোর।
চোখ মিটমিট করল রবিন। ওপরে তারাজ্বলা আকাশ। মুখের ওপর ঝুঁকে আছে মরিডো। চিত হয়ে পড়ে আছে সে। প্রচণ্ড যন্ত্রণা মাথায়।
রবিন, কোথাও লাগেনি তো! আবার জিজ্ঞেস করল মরিডো। উদ্বিগ্ন।
মাথা ব্যথা করছে, অবশেষে বলল রবিন। কোলা ব্যাঙের আওয়াজ বেরোল গলা থেকে। ভালই আছি। ধীরে ধীরে উঠে বসল সে। চারদিকে তাকাল। একটা ব্যালকনিতে বসে আছে। পাশে, প্যালেসের পাথরের কালো বিশাল দেয়াল উঠে গেছে ওপরে। অনেক নিচে ডেনজো নদীতে মিটমিট করছে নৌকার আলো।
আমি এখানে কেন! বলে উঠল রবিন। জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকলেন আপনারা…তারপরই আমি এখানে!…মাথায় যন্ত্রণা।…কিছুই তো বুঝতে পারছি না!
প্রিন্স পল রক্ষা করুন আমাদের, বিড়বিড় করল মরিডো। কথা বলার সময় নেই! দড়ি ধরে উঠতে পারবেন? এই যে, দড়ি। রবিনের। হাতে দড়িটা গুঁজে দিল সে। উঠতে পারবেন?
অবাক হয়ে দড়িটা ধরে আছে রবিন। এটা কোথা থেকে এল? এর আগে কখনও দেখেছে বলে তো মনে পড়ছে না। ভীষণ দুর্বল লাগছে। মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা।
জানি না! ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল রবিন। চেষ্টা করব।
হবে না! আপনমনেই বিড়বিড় করল মরিডো। বুঝেছি, পারবেন না। টেনে তুলতে হবে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকুন। দড়ি বেঁধে টেনে তুলব।
দড়ির মাথা রবিনের দুই বগলের তলা দিয়ে এনে বুকে শক্ত করে পেঁচাল মরিডো, গিঁট দিল। চুপ করে থাকুন। আমি উঠে যাই। তারপর টেনে তুলব। দেয়ালে অনেক ফাটল আছে। ওগুলোতে পা বাধিয়ে ওপরে ঠেলে দেবার চেষ্টা করবেন নিজেকে। আমাদের সাহায্য হবে। তা যদি না পারেন, চুপচাপ ঝুলে থাকবেন। ভয় নেই, ফেলে দেব না।
দড়িতে টান পড়তেই ওপরের দিকে চেয়ে বলল, আসছে! অঘটন ঘটেছে এখানে!
দড়ি ধরে রেলিঙে উঠে দাঁড়াল মরিড়ো। ঝুলে পড়ল অন্ধকারে।
নিঃশব্দে উঠে যাচ্ছে মরিডো। সেদিকে তাকিয়ে রইল রবিন। হাত চলে গেছে মাথার পেছনে, আহত জায়গা। এখনও বুঝতে পারছে না সে, কি করে এখানে এল! সঙ্গীরা কোথায় কি করছে, বুঝতে পারছে। মনে পড়ছে, ওরা ঘরের ভেতরে দাঁড়িয়ে ছিল। দরজায় কুড়াল দিয়ে কোপানর শব্দ। জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর এসে লাফিয়ে নেমেছে। দুই তরুণ…
.
বড় একটা জানালার চৌকাঠে বসল মরিডো। লাফ দিয়ে নামল ভেতরে। ওরা তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। সবাই উদ্বিগ্ন।
পড়ে গিয়েছিল রবিন, বলল মরিডো। খুব নাড়া খেয়েছে। চোট লেগেছে মাথায়। টেনে তুলতে হবে, নিজে নিজে উঠতে পারবে না। আসুন, দড়ি ধরতে হবে।
চারজনেই চেপে ধরল দড়ি। টান দিল। ওঠার সময় সাহায্য করেছে গিটগুলো, এখন অসুবিধে সৃষ্টি করল। প্রতিটি গিঁট বেধে যাচ্ছে। চৌকাঠের কিনারে, আটকে যাচ্ছে। হ্যাঁচকা টান দেয়া যাচ্ছে না। গিটের তলায় হাত ঢুকিয়ে দিয়ে সরিয়ে আনতে হচ্ছে অনেক কষ্টে।
ওজন বেশি না রবিনের। তাছাড়া ওরা চারজন। অসুবিধা সত্ত্বেও শিগগিরই দেখা গেল তার মাথা, কাঁধ। হাত বাড়িয়ে চৌকাঠ চেপে ধরল রবিন। দুহাত ধরে তাকে তুলে আনল মুসা আর মরিডো।
এলাম! কাঁপছে রবিনের গলা। কিছু ভেব না, আমি ঠিকই আছি। মাথা ব্যথা করছে অবশ্য, ওটা এমন কিছু না। হাঁটতে পারব। কিন্তু ব্যালকনিতে কি করে এলাম, সেটাই মনে করতে পারছি না!
পারবেন, মোলায়েম গলায় বলল মেরিনা। ওসব নিয়ে বেশি ভাবার দরকার নেই এখন। আর কোন অসুবিধে নেই তো?
না, বলল রবিন।
আরেকটা শোবার ঘরে এসে ঢুকেছে ওরা। ভাপসা গন্ধ। অনুভবেই বুঝতে পারছে, বালি গিজগিজ করছে। তারার আবছা আলো জানালা দিয়ে ঢুকছে ভেতরে। কোন আসবাবপত্র দেখা গেল না।
পা টিপে টিপে দরজার কাছে এগিয়ে গেল মরিডো আর মেরিনা। নিঃশব্দে দরজা খুলল মরিডো, গলা বাড়িয়ে উঁকি দিল বাইরে। ফিরে এল আবার।
কেউ নেই, বলল মরিডো। লুকানর জন্যে একটা জায়গা বের করতে হবে এবার। মেরিনা, তোমার কি মনে হয়? মাটির তলার কোন একটা ঘরে নিয়ে যাব?
ননাহ, জোরে মাথা নাড়ল মেরিনা। দড়ি দেখে ভাববে, নিচে নেমে গেছেন ওঁরা। নিচের কোন, ঘরেই খোঁজা বাদ রাখবে না ব্যাটারা। দেখ!
জানালায় দাঁড়িয়ে নিচে উঁকি দিল সবাই। নিচে, আঙিনায় আলো, নড়াচড়া করছে। টর্চ হাতে ঘুরে বেড়াচ্ছে প্রহরীরা।
ইতিমধ্যেই পাহারা শুরু হয়ে গেছে আঙিনায়, বলল মেরিনা। ওপরেই যেতে হবে আমাদের। দিনটা কোথাও লুকিয়ে রাখতে হবে। আগামী রাতে দেখব, অন্য কোথাও সরিয়ে নিতে পারি কিনা। কোন একটা ডানজনের ভেতর দিয়ে পানি সরার ড্রেনে নিয়ে যাব। তারপর হয়ত নিয়ে চলে যেতে পারব আমেরিকান এমব্যাসিতে।
ভাল বলেছ, সায় দিয়ে বলল মরিডো। প্যালেসের এদিকটায় লোকজন আসে না। দড়ি নিচে নেমে গেছে, এদিকে ওঠার কথা ভাববে না কেউ।…সঙ্গে রুমাল আছে আপনাদের?
আছে, পকেট থেকে সাদা রুমাল বের করে দিল কিশোর।
নিচে আঙিনায় ফেলে দেব সুযোগমত, বলে রুমালটা পকেটে রাখল মরিভো। জানালার ফ্রেমের মাঝখানের দণ্ডে বাঁধা দড়িটা, ওটা বেয়েই উঠে এসেছে। খুলে নিয়ে হাতে পেচাল সে। আসুন, যাই। মেরি, পেছনে থাক।
একে একে করিডরে বেরিয়ে এল ওরা। দুপাশে ঘর। ওপরে ছাত। অন্ধকার। মরিডোর হাত ধরেছে কিশোর। তার হাত মুসা, মুসার হাত রবিন। তার হাত মেরিনা। পাঁচজনের একটা শেকল যেন, নিঃশব্দ কিন্তু দ্রুতপায়ে এগিয়ে চলল।