.
০৭.
জোরে জোরে কিল মারার শব্দ হচ্ছে দরজায় বাইরে থেকে।
খোল! রিজেন্টের আদেশ! আমরা আইনের লোক! আবার চেঁচিয়ে উঠল ক্রুদ্ধকণ্ঠ।
দরজায় পিঠ দিয়ে চেপে দাঁড়িয়েছে কিশোর আর মুসা। নিজেদের দেহের ভার দিয়ে দরজা আটকে রাখতে চাইছে যেন।
হাতের অপূর্ব সুন্দর জিনিসটার দিকে চেয়ে আছে রবিন। মাথায় চিন্তার ঝড়। কোথাও লুকিয়ে ফেলা দরকার এটাকে। কিন্তু কোথায়?
হঠাৎ সচল হয়ে উঠল রবিন। ছুটোছুটি শুরু করল সারা ঘরময়। চোখ জায়গা খুঁজছে। কোথায় লুকিয়ে রাখবে মাকড়সাটাকে! কার্পেটের তলায়? না। বিছানার গদি? তাও না। তাহলে, তাহলে কোথায়? কোথায় রাখলে খুঁজে পাবে না অন্য কেউ?
জোরে ধাক্কা দেয়া হচ্ছে দরজায়। ভেঙে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে। এই সময়ই ঘটল আরেক ঘটনা। ভীষণভাবে দুলে উঠল জানালার পর্দা। লাফিয়ে এসে ঘরের ভেতরে পড়ল দুজন তরুণ! চমকে উঠল কিশোর আর মুসা! ওদিক থেকেও আক্রমণ এল।
না না, চমকাবার কিছু নেই। কাছে এগিয়ে এসেছে এক তরুণ। ফিসফিস করে বলল, আমি। মরিডো। আর, ও আমার ছোট বোন, মেরিনা।
মেরিনা…ও আপনার বোন, ফিসফিস করেই বলল কিশোর।
সেই মেয়েটা। পার্কে বেলুন বিক্রি করছিল যে। পরনে মরিডোর মতই প্যান্ট, জ্যাকেট। দেখে প্রথমে তাই তাকে ছেলে বলে ভুল করেছে ওরা।
মাথা ঝোকাল মরিডো। জলদি আসুন, পালাতে হবে। আপনাদেরকে অ্যারেস্ট করতে এসেছে ওরা! ধরতে পারলে ফাঁসি দিয়ে দেবে!
আওয়াজ পাল্টে গেছে আঘাতের। দরজা ভাঙার জন্যে কুড়াল ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু তিন ইঞ্চি পুরু ভারি ওক কাঠের দরজা। এত সহজে ভাঙবে না। কয়েক মিনিট সময় নেবেই।
ঘরে বসে টেলিভিশনে সিনেমা দেখছে যেন ওরা! খুব দ্রুত ঘটে যাচ্ছে ঘটনা। তাল পাচ্ছে না তিন গোয়েন্দা। বেরিয়ে যেতেই হবে এঘর থেকে, এটা ঠিক, কিন্তু কি করে, বুঝতে পারছে না।
জলদি এস, মুসা! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। কাজ করতে শুরু করেছে আবার তার মগজ। রবিন, এস। মাকড়সাটা পকেটে ঢোকাও।
ঘরের কোণে দাঁড়িয়ে আছে রবিন। হঠাৎ সোজা হল। দ্বিধা করল এক মুহূর্ত। তারপর ঘুরে ছুটে এল।
জানালার দিকে ছুটল মেরিনা। ফিরে সবাইকে একবার ইশারা করেই টপকে ব্যালকনিতে চলে গেল। ওর পিছু পিছু ব্যালকনিতে এসে নামল কিশোর, মুসা, রবিন।
ঠাণ্ডা অন্ধকারে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াল ওরা। নিচে জ্বলছে শহরের আলো।
দালানের গা থেকে বেরিয়ে আছে চওড়া কার্নিস। সেটা দেখিয়ে বলল, প্যালেসের পেছনেও আছে। এতখানিই চওড়া। হাঁটা যাবে। আসুন আমি পথ দেখাচ্ছি।
ব্যালকনির রেলিঙে উঠে বসল মেরিনা। নিঃশব্দে লাফিয়ে নামল কার্নিসে।
দ্বিধা করছে কিশোর। আমার ক্যামেরা! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে। ফেলে রেখে এসেছি!
আর আনার সময় নেই! পেছন থেকে বলল মরিডো। দুমিনিট টিকবে আর দরজা, বড় জোর তিন। একটা সেকেণ্ডও নষ্ট করা যাবে না।
খুব খারাপ লাগল ক্যামেরাটার জন্যে। কিন্তু আনার উপায় নেই। মুসা নেমে পড়েছে ততক্ষণে কার্নিসে। তাকে অনুসরণ করল কিশোর। দেয়ালের দিকে মুখ, পা ফাঁক করে পাশে হেঁটে সরছে মেরিনা।
গায়ে গা ঠেকিয়ে মেরিনার মত করেই সরতে লাগল মুসা আর কিশোর। বেড়ালের মত নিঃশব্দে।
ভয় পাবার সময়ই নেই। ঘরের ভেতরে দরজায় আঘাতের শব্দ হচ্ছে একনাগাড়ে। প্রাসাদের এক কোণে পৌঁছে গেল ওরা। ঠাণ্ডা হাওয়া ঝাঁপটা দিয়ে গেল চোখেমুখে।
ক্ষণিকের জন্যে কেঁপে উঠল রবিন, দুলে উঠল দেহ। অনেক নিচে ডেনজো নদী, রাতের মতই অন্ধকার। পাক খেয়ে খেয়ে ঘূর্ণি সৃষ্টি করেছে পানি, শব্দ শোনা যাচ্ছে। কাঁধ খামচে ধরল মরিডোর শক্তিশালী হাত, পতন রোধ করল রবিনের। আবার ভারসাম্য ফিরে পেল সে।
জলদি! রবিনের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল মরিডো।
চমকে উঠল একজোড়া পায়রা। এ-কি জ্বালাতন! এত রাতে ঘুম নষ্ট করতে এল কে! পাখার ঝটপট শব্দ তুলে দালানের খোপ থেকে বেরিয়ে এল পাখি দুটো, অনধিকার-চর্চাকারীদের মাথার ওপর চক্কর দিয়ে দিয়ে উড়তে লাগল। হঠাৎ বসে পড়তে যাচ্ছিল রবিন, আবার তার কাঁধ খামচে ধরল মরিডো।
মোড় ঘুরে আরেকটা ব্যালকনির কাছে চলে এল ওরা। রেলিঙে উঠে বসল মেরিনা। নামল।
ব্যালকনিতে এসে দাঁড়িয়েছে পাঁচজনে।
এবার ওপরে উঠতে হবে, ফিসফিসিয়ে বলল মেরিনা। এই যে দড়ি। গিঁট দেয়া আছে একটু পর পরই। উঠতে অসুবিধে হবে না!
এটা কেন? রেলিঙে বাঁধা আরেকটা দড়ি নেমে গেছে নিচে, সেটা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ওদের বোকা বানাতে, জবাব দিল মেরিনা। ধরে নেবে আমরা নিচে নেমে গেছি।
ওপর থেকে ঝুলছে যে দড়িটা, সেটা ধরে উঠতে শুরু করল মেরিনা। তাকে অনুসরণ করল মুসা। তারপর দড়ি ধরল কিশোর।
ওদেরকে কয়েক ফুট ওঠার সময় দিল রবিন। তারপর দড়ি ধরে ঝুলে পড়ল সে-ও। উঠতে শুরু করল ধীরে ধীরে।
আবার কার্নিসে নেমেছে মরিডো। মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে গেল কোনায়। উঁকি দিল। দেখতে চাইছে, ওদিকে কতদূর কি করল শত্রুরা।
ফিরে এল মরিডো। ফিসফিস করে বলল, এখনও দরজা নিয়েই আছে। তবে এসে পড়ল বলে!
কি? মরিডোর দিকে তাকাতে গেল রবিন। ঘামে ভেজা হাত, পিছলে গেল হঠাৎ। গিটও আটকাতে পারল না, সড়সড় করে নিচে নেমে চলে এল সে। ঘষা লেগে ছিলে গেল হাতের চামড়া। তার মনে হল, আগুন লাগিয়ে দিয়েছে কেউ। মাত্র একটা মুহূর্ত। পরক্ষণেই এসে পড়ল নিচে দাঁড়ানো মরিডোের ওপর। পড়ল তাকে নিয়েই। জোরে কঠিন কিছুতে ঠুকে গেল মাথা। দপ করে চোখের সামনে জ্বলে উঠল কয়েক হাজার লাল-হলুদ ফুল। তারপরেই অন্ধকার!