দুপাশে নতুন নতুন দৃশ্য। দেখতে দেখতে কিছুক্ষণের জন্যে সিক্রেট সার্ভিসের কথা ভুলে গেল ছেলেরা।
আরেকটা পার্কে বিশাল এক নাগরদোলায় চেপে কিছুক্ষণ দোল খেল তিন কিশোর। তারপর রাতের খাওয়া সেরে নিল এক রেস্টুরেন্টে। ডেনজো নদীর মাছ, সুস্বাদু। রান্নাও হয়েছে খুব ভাল।
ক্লান্ত হয়ে প্যালেসে ফিরে এল ওরা। তবে মন আনন্দে ভরা। একটা খুব সফল দিন কাটিয়ে এসেছে।
ওদেরকে অভ্যর্থনা করে গাড়ি থেকে নামাল রয়্যাল চেম্বারলেন। এখন আরেকজন। ডিউটি বদলেছে। ছোট্টখাট্ট একজন তোক। টকটকে লাল আলখেল্লা পরনে।
গুড ইভনিং, ইয়ং জেন্টেলম্যান, বলল চেম্বারলেন। আজ রাতে দেখা করতে পারবেন না প্রিন্স দিমিত্রি। দুঃখ প্রকাশ করেছেন তিনি। কাল সকালে নাস্তার সময় দেখা হবে। চলুন, আপনাদের ঘরে পৌঁছে দিই। নইলে পথ চিনে যেতে পারবেন না।
অসংখ্য সিঁড়ি, করিডর, হলঘর পেরিয়ে এল ওরা চেম্বারলেনের পিছু পিছু। প্রতিটি সিঁড়ির গোড়ায় করিডরের প্রান্তে প্রহরী। অবাকই হল ওরা। সকালে, কিংবা গতরাতে এত কড়াকড়ি দেখেনি। তিনতলার ঘরে পৌঁছে দিয়ে তাড়াহুড়া করে চলে গেল চেম্বারলেন। যেন জরুরি কোন কাজ ফেলে এসেছে।
ভারি ওক কাঠের দরজাটা বন্ধ করে দিল কিশোর। ঘরের ভেতরে তাকাল। গোছগাছ সাফসুতরো করা হয়েছে। বিছানায় নতুন চাদর। তবে সুটকেসগুলো যেখানে ফেলে রেখে গিয়েছিল, সেখানেই রয়েছে। মাকড়সার জালটাও রয়েছে আগের মতই। ওটার ধারেকাছেও যায়নি কেউ। সেদিকে এগোল, সে। সুতো বেয়ে নেমে গেল বড় একটা মাকড়সা, কালোর ওপর সোনালি ছোপ। তক্তা আর মেঝের মাঝখানের ফাঁকে গিয়ে ঢুকে পড়ল সুড়ৎ করে। মাথা বের করে দিল পরমুহূর্তেই।
হাসল রবিন। সকালেই যথেষ্ট শিক্ষা হয়ে গেছে। মাকড়সার জাল আর ছিঁড়তে যাবে না ভ্যারানিয়ায় থাকতে।
মনে হচ্ছে, জিনিসপত্র কেউ হাতায়নি, বলল কিশোর। বব ব্রাউনের সঙ্গে যোগাযোগ করা দরকার। নতুন কোন নির্দেশ দিতে– পারে। মুসা, দরজার তালা আটকে দাও।
তালা আটকে দিল মুসা।
খাপ থেকে ক্যামেরা খুলল কিশোর। বোতাম টিপে দিল। ফাস্ট বলছি। শুনতে পাচ্ছেন?
স্পষ্ট, ভেসে এল বব ব্রাউনের গলা। নতুন কিছু
তেমন কিছু না, জানাল কিশোর। সারা বিকেলই গাড়িতে করে ঘুরেছি। শহর দেখেছি। নতুন চর লেগেছিল পেছনে। ডিউক রোজারের লোক, সিক্রেট সার্ভিস।
দিমিত্রির সঙ্গে কথা বলেছ? কণ্ঠ শুনে মনে হল ভাবনায় পড়ে গেছে। খবরটা কিভাবে নিয়েছে সে?
দেখা হয়নি। চেম্বারলেন জানিয়েছে, সকালের আগে দেখা হবে না। প্রিন্স খুব ব্যস্ত।
হুমম! দুশ্চিন্তায় পড়ে গেছে বব, তার কণ্ঠ শুনেই বোঝা যাচ্ছে। আটকে ফেলেনি তো! ওর সঙ্গে দেখা করা খুবই জরুরি। সকালে যেভাবেই হোক, দেখা কোরো। হ্যাঁ, এক কাজ কর, ক্যামেরা থেকে টেপটা বের করে নিয়ে পকেটে রেখে দাও। আগামীকাল এমব্যাসিতে নিয়ে আসবে। এমন ভাব দেখাবে, যেন শহর দেখতে বেরোচ্ছ। গরম হয়ে উঠছে পরিস্থিতি! বুঝেছ?
বুঝেছি, বলল কিশোর। ওভার অ্যান্ড আউট।
ট্রান্সমিটারের সুইচ অফ করে দিল কিশোর। টেপ-রেকর্ডার থেকে বের করে নিল খুদে ক্যাসেটটা। বাড়িয়ে দিল মুসার দিকে, এটা তোমার কাছে রাখ। কেউ যেন নিয়ে যেতে না পারে।
পারবে না, দৃঢ়কণ্ঠ মুসার। ভেতরের পকেটে রেখে দিল ক্যাসেটটা।
ড্রয়ার হাতাচ্ছে রবিন। রুমাল খুঁজছে। কোন্ ড্রয়ারটীয় রেখেছিল, ঠিক মনে করতে পারছে না। অবশেষে একটা ড্রয়ারে পাওয়া গেল ওটা। টান দিয়ে বের করে আনল রুমাল। ভাঁজের ভেতর থেকে মেঝেতে ছিটকে পড়ল কিছু একটা, মৃদু টুং শব্দ হল। আশ্চর্য! কি ওটা! ঝুঁকে আলমারির তলায় তাকাল। চকচক করছে জিনিসটা। বের করে হাতে নিল।
একবার দেখেই চেঁচিয়ে উঠল রবিন, কিশোর! মুসা! দেখ দেখ!
অবাক হয়ে তাকাল দুজনেই।
মাকড়সা! ঢোক গিলল মুসা। ফেল, ফেল!
কোন ক্ষতি করে না, বলল কিশোর। প্রিন্স পলের মাকড়সা। রবিন, আস্তে নামিয়ে রাখ মেঝেতে।
চিনতে পারছ না! ভুরু কুঁচকে গেছে রবিনের। প্রিন্স পলের মাকড়সাই। রূপালী মাকড়সা!
রূপালী মাকড়সা! রবিনের কথার প্রতিধ্বনি করল যেন মুসা। কি বলছ।
এটা ভ্যারানিয়ার রূপালী মাকড়সা, বলল রবিন। ভল্ট থেকে যেটা চুরি গিয়েছিল। আমি শিওর। এত কাছে থেকেও চিনতে পারনি?
প্রায় লাফ দিয়ে কাছে চলে এল কিশোর আর মুসা।
ছুঁয়ে দেখল কিশোর। ঠিকই বলেছ! এটা একটা মাস্টারপিস। কোথায় পেলে?
রুমালের ভাঁজে! কেউ একজন রেখে দিয়েছে। সকালে ছিল না।
ভুরু কুঁচকে গেল কিশোরের। নিজের অজান্তেই হাত উঠে গেল। নিচের ঠোঁটে। কে রাখল? কেন? বিড়বিড় করতে লাগল। আমাদেরকে চোর বলে চিহ্নিত করতে চায় না-তো। তাহলে…
কি করব আমরা এখন, কিশোর? বলে উঠল মুসা। ওটা চুরির একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদণ্ড! যদি ধরা পড়ি…
আমার মনে হয়… বলতে গিয়েও থেমে যেতে হল কিশোরকে। বাইরে ভারি জুতোর শব্দ। অনেকগুলো।
মুহূর্ত পরেই দরজায় চাপড়ের শব্দ হল। নবটা ঘোরানর চেষ্টা করল কেউ। ভেতর থেকে তালা দেয়া, খুলল না। শোনা গেল কুদ্ধ গলা, দরজা খোল। রিজেন্টের আদেশ!
স্তব্ধ একটা সেকেণ্ড। তারপরই লাফ দিল মুসা আর কিশোর, একই সঙ্গে। লোহার দুটো ভারি ছিটকিনি তুলে দিল দুজনে।
ঠিকমত ভাবতে পারছে না রবিন, এতই অবাক হয়েছে। হাতে ভ্যারানিয়ার রূপালী মাকড়সা নিয়ে স্থির দাঁড়িয়ে আছে। কি করবে এখন?