রূপার ওপর এনামেল, বলল দিমিত্রি। কালো এনামেলের ওপর সোনালি ছোপ দেয়া হয়েছে। আসলটা এরচেয়ে অনেক সুন্দর।
নকলটা দেখেই অবাক হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা। আসলটা কত সুন্দর? এপাশ থেকে ওপাশ থেকে, ওপর থেকে নিচ থেকে, সব দিক। থেকেই জিনিসটাকে খুঁটিয়ে দেখল ওরা, যাতে দেখামাত্র চিনতে পারে আসলটা, অবশ্য যদি কপাল গুণে পায় ওরা!
গত হপ্তায় চুরি হয়েছে জিনিসটা, তিক্ত কণ্ঠে বলল দিমিত্রি। আমার সন্দেহ ডিউক রোজারকে। একমাত্র ওর পক্ষেই অকাজটা করা সম্ভব। কিন্তু প্রমাণ ছাড়া কিছু বলতে পারব না। ভ্যারানিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা এমনিতেই খুব নাজুক। সুপ্রীম কাউন্সিলের সব। মেম্বারই রোজারের লোক। ধরতে গেলে কোন ক্ষমতাই নেই এখন আমার। ওরা চায় না, আমি প্রিন্স হই। সবরকমে বাধা দেবার জন্যে। তৈরি হচ্ছে। তার প্রথম ধাপ, এই চুরি। সরিয়ে ফেলা হল রূপালী মাকড়সা, জোরে একবার শ্বাস টানল সে। আর বেশিক্ষণ থাকতে পারব না। একটা মীটিঙ আছে আমার। বাইরে বেরোতে পারব না। তোমাদের সঙ্গে। শহর দেখতে চাইলে, তোমাদেরকে একা যেতে হবে। রাতে, ডিনারের পর দেখা হবে আবার।
ভল্ট থেকে বেরিয়ে এল ওরা। প্রতিটি দরজায় তালা লাগাল দিমিত্রি। মিউজিয়মে বেরিয়ে এল বন্ধুদের নিয়ে। করিডরে বেরিয়ে হাত মেলাল। কোন্ পথে বেরোতে হবে প্রাসাদ থেকে বলে দিল। বলে দিল, কোথায় গাড়ি অপেক্ষা করবে।
ড্রাইভারের নাম মরিডো, বলল দিমিত্রি। আমার খুব বিশ্বাসী। ওর সঙ্গে যেতে পার তোমরা নিশ্চিন্তে। একটু থেমে বলল, রাজকুমার হয়ে জন্মানো খুবই বিরক্তির ব্যাপার। জীবনের কোন স্বাদ নেই। তবু চিরদিন তাই থাকতে হবে আমাকে। যাকগে, ঘুরে এস। রাতে দেখা হবে।
ঘুরে করিডর ধরে হাঁটতে শুরু করল দিমিত্রি। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে গেল দ্রুত।
মাথা চুলকাল রবিন। কিশোর, কি মনে হয়? মাকড়সাটা খুঁজে বের করতে পারব?,
ঠোঁট বাঁকাল কিশোর, কাঁধ ঝাঁকাল। জোরে একবার শ্বাস টেনে বলল, জানি না! কোন উপায় দেখছি না আমি!
০৫.
শহরের ভেতর দিয়ে ছুটে চলেছে গাড়ি।
দুধারের দৃশ্য বেশ লাগছে ছেলেদের কাছে। ক্যালিফোর্নিয়ায়, সব কিছুই নতুন। এখানে ঠিক তার উল্টো। সব কিছুই অবিশ্বাস্য রকমের পুরানো। পাথরের তৈরি বাড়িঘর, কোথাও কোথাও হলুদ ইটের। বেশির ভাগ ছাত লাল টালির। প্রতিটি ব্লকের পর একটা করে ফোয়ারা। ঝাঁকে ঝাঁকে কবুতর দেখা যাচ্ছে এদিক ওদিক। সেইন্ট ডোমিনিকসের সামনের আঙিনাতেই রয়েছে কয়েকশো।
পুরানো একটা ছাতখোলা বেড়ানর-গাড়ি। ড্রাইভার এক তরুণ, সবে কৈশোর পেরিয়েছে। চমৎকার ইংরেজি বলে। নাম, মরিডো। গাড়িতে ওঠার পর পরই নিচু গলায় জানিয়েছে, তাকে নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করতে পারে তিন কিশোর। প্রিন্স দিমিত্রিও তাকে খুবই বিশ্বাস করেন। ফিটফাট পোশাক পরনে।
ডেনজোর বাইরে পাহাড়ের কাছে চলে এল-গাড়ি। পাহাড়ী পথ ধরে উঠে গেল ওপরে। গাড়ি থেকে নেমে চূড়ায় গিয়ে উঠল তিন গোয়েন্দা। ওখান থেকে ডেনজো নদী আর শহরের বেশ কয়েকটা ছবি তুলল। ফিরে এসে গাড়িতে উঠল আবার। চলতে শুরু করল গাড়ি।
আমাদেরকে অনুসরণ করা হচ্ছে, নিচু গলায় বলল মরিডো। প্যালেস থেকে রেরোনর পর পরই পিছু নিয়েছে। পার্কে নিয়ে যাচ্ছি আপনাদের। ঘোরাফেরা করবেন, বিভিন্ন জিনিস দেখবেন। অনেক মজার জিনিস আছে। সাবধান, পেছনে ফিরে তাকাবেন না একবারও। ওদেরকে দেখে ফেলেছি, ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দেবেন না।
খুব কঠিন নির্দেশ! অনুসরণ করছে জানা সত্ত্বেও পেছনে ফিরে চাইতে পারবে না। কিন্তু কারা অনুসরণ করছে? কেন?
কি ঘটছে, জানতে পারলে ভাল হত, পথের দিকে চেয়ে আছে। মুসা। কেন আমাদেরকে অনুসরণ করছে? আমরা তো তেমন কিছুই। জানি না!
কেউ একজন হয়ত ভাবছে, জানি, বলল কিশোর।
এবং জানলে সত্যি ভাল হত, যোগ করল রবিন।
গাড়ি দাঁড় করিয়ে দিল মরিডো। বেশ বড় একটা জায়গায় পৌঁছে গেছে ওরা। প্রচুর গাছপালা। লোকের ভিড়। বাজনার মৃদু শব্দ ভেসে আসছে।
এটা আমাদের প্রধান পার্ক, গাড়ির দরজা খুলতে খুলতে বলল। মরিডো। ধীরে ধীরে হেঁটে মাঝখানে চলে যান। পেরিয়ে যাবেন ব্যাণ্ডস্ট্যাণ্ড। দড়াবাজ আর ভাঁড়দের কাছে গিয়ে দাঁড়াবেন। ছবি তুলবেন। তারপর গিয়ে দাঁড়াবেন বেলুন বিক্রি করছে যে মেয়েটা, তার কাছে। ছবি তোলার প্রস্তাব দেবেন। আমি এখানেই অপেক্ষা করছি। আবার বলছি পেছনে তাকাবেন না। কোনরকম দুশ্চিন্তা করবেন না, অন্তত এখনও না।
এখনও না! মরিডোর কথার প্রতিধ্বনি করল যেন মুসা। গাছপালার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছে। জোরাল হচ্ছে। বাজনার শব্দ। পেছনে ফিরে তাকাব না। কত আর সামনে তাকিয়ে থাকা যায়!
দিমিত্রিকে কি করে সাহায্য করতে পারি আমরা? নিচু গলায় বলল রবিন। অন্ধকারে হাতড়ে মরছি! শূন্য, কিছুই ঠেকছে না হাতে!
অপেক্ষা করতে হবে, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। আমার ধারণা, কারও সঙ্গে যোগাযোগ করছি কি না, দেখার জন্যেই অনুসরণ করা হচ্ছে।
আরও খানিকটা হেঁটে একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল ওরা। ঘাসের ওপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে আছে অনেক লোক। খুদে একটা ব্যাণ্ডস্ট্যাণ্ডে দাঁড়িয়ে আছে আটজন বাদক, হাতে নানারকম বাদ্যযন্ত্র। পরনে বিচিত্র উজ্জ্বল রঙের পোশাক। বাদকদলের নেতা মরিডোর। বয়েসী এক তরুণ। একটা নরম সুর বাজিয়ে থামল ওরা। প্রচুর। হাততালি আর বাহবা পেল। মাথা নুইয়ে শ্রোতাদের অভিবাদন জানিয়ে প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আরেকটা সুর ধরল। চড়া, দ্রুত লয়।