ঠিক আছে, রাজি হল দিমিত্রি। কিন্তু ৰুবাতে অসুবিধে হল না তিন গোয়েন্দার, রোজারকে সঙ্গে নেবার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই রাজকুমারের। কিন্তু বেশিক্ষণ আমাদের সঙ্গে থাকার দরকার নেই আপনার। কাজের ক্ষতি হবে। তাছাড়া একটু পরেই কাউন্সিলা মীটিঙে বসতে হবে।
হ্যাঁ, পেছনে পেছনো আসছে রোজার। অভিষেক অনুষ্ঠানে কি কি করতে হবে না হবে, সব ঠিক করতে হবে আজই। তা হলেও, কিছুটা সময় দিতে পারব এখন।
আর কিছু বলল না দিমিত্রি। বন্ধুদেরকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। করিডরের একপাশে একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। তাদেরকে নিয়ে ঢুকে পড়ল বিশাল এক ঘরে।
অনেক উঁচু ছাত, দোতলার সমান। দেয়ালে দেয়ালে ঝুলছে ছবি। কাঁচের বাক্সে বোঝাই হয়ে আছে পুরো ঘরটা। প্রাচীন সব ঐতিহাসিক জিনিস রক্ষিত রয়েছে ওগুলোতে। পতাকা, শীল্ড, মেডাল, বই এবং অন্যান্য আরও অনেক জিনিস। প্রতিটি বাক্সের গায়ে একটা করে সাদা কার্ড সাটা, তাতে ইংরেজিতে টাইপ করে লেখা রয়েছে ভেতরের জিনিসগুলোর নাম এবং সংক্ষিপ্ত বিব্রণ।
একটা বাক্সে একটা ভাঙা তলোয়ার। ওটার ওপর ঝুঁকে দাঁড়াল তিন গোন্দো। কার্ডের লেখা পড়ে জানল, ওটা প্রিন্স পলের তলোয়ার। ১৬৭৫-এ ওটা দিয়েই যুদ্ধ করেছিলেন তিনি।
এই যে, এই ঘরটাতেই রয়েছে আমাদের জাতির পুরো ইতিহাস, পেছন থেকে বলে উঠলা ডিউক রোজার। ছোট্ট দেশ, ক্ষুদ্র একটা জাতি আমরা, ইতিহাস তেমন কিছুই থাকার কথা না। নেইও। বিশাল এক দেশ থেকে এসেছেন, এসব নিশ্চয় ভাল লাগবে না। মনে হবে, অনেক বেশি প্রাচীন।
না না, মোলায়েম গলায় বলল কিশোর। মহান এক জাতি বলেই মালে হচ্ছে ভ্যারানিয়ানরা। বেশ ভাল লাগছে আমার।
আপনার দেশের অনেকের কাছেই আমাদের রীতিনীতি পছন্দ না, বলাল ব্রোজারি। মধ্যযুগীয় বর্বর বলে হাসাহাসি করে। এখন ভাল বলছেন বটে, তবে শিগগিরই বিক্ত হয়ে যাবেন।…ও হ্যাঁ, আমার এখুলি যেতে হবে। মীটিঙের দেরি হয়ে যাবে নইলে।
কারও কিছু বলার অপেক্ষা করল না ডিউক। ঘুরে হাঁটতে শুরু করল।
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল রবিন। শিওর, ও আমাদেরকে পছন্দ করেনি? লিচু গলায় বলল।
কারণ, তোমরা আমার বন্ধু, যোগ করল দিমিত্রি। আমার কোন বন্ধু থাকুক, চায় না সে। ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে চলি, কিংবা কথা বলি, এটাও অপছন্দ। বাদ দাও ওর কথা। এস, প্রি পলের ছবি দেখাচ্ছি।
দেয়ালে ঝোলানো লাইফ-সাইজ একটা ছবির সামনে নিয়ে এল ওদেরকে দিমিত্রি। দক্ষ শিল্পীর হাতে আঁকা। উজ্জ্বল লাল পোর্শকে সোনালি বোতাম, হাতের তলোয়ারের মাখা মেঝের দিকে। সম্ভ্রান্ত। চেহারা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। অন্য হাতটা সামনের দিকে বাড়ানো। তাতে বসে আছে একটা মাকড়সা। সত্যিই সুন্দর, কালোর ওপর সোনালি ছোপ
আমারি পূর্বপুরুষ, গর্বিত কণ্ঠে বলল দিমিত্রি। অপরাজেয় প্রিন্স পল। হাতে যেটা দেখছ, ওরকম, একটা মাকড়সা প্রাণ বাঁচিয়েছিল তাঁর।
ছবিটা দেখছে তিন গোয়েন্দা। পেছনে কথাবার্তা শোনা যাচ্ছে।
ঘরে এসে ঢুকেছে দর্শকরা। বিভিন্ন ভাষায় কথা হচ্ছে, তারমাঝে ইংরেজিও আছে। বেশির ভাগই টুরিস্ট। কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরা, হাতে গাইড বুক। দরজায় দাঁড়িয়েছে এসে দুজন প্রহরী। হাতে বল্লম। পরনে তিনশো বছর আগের ছাঁটের ইউনিফর্ম। সেই পুরানো কায়দায় ক্রস বানিয়ে ধরে রেখেছে দুটো বল্লম, কেউ ঢুকতে কিংবা বেরোতে গেলেই সালাম ঠুকে সরিয়ে নিচ্ছে। পেছনে ফিরে একবার দেখল মুসা, তারপর আবার তাকাল ছবির দিকে।
চার কিশোরের ঠিক পেছনে এসে দাঁড়াল এক আমেরিকান দম্পতি।
বিচ্ছিরি! কানের কাছে কথা শোনা গেল মহিলার। দেখছ কি জঘন্য একটা মাকড়সা হাতে নিয়েছে!
শশশ! চাপা পুরুষ-কণ্ঠ। আস্তে বল! কেউ শুনে ফেলবে! ওটা ওদের জাতীয় জীব, সৌভাগ্য বয়ে আনে। বাজে মন্তব্য কোরো না!
আমি ওসব কেয়ার করি না, উদ্ধত কণ্ঠ মহিলার। সামনে পড়লে দেব জুতো দিয়ে মাড়িয়ে।
মুচকে হাসল মুসা আর রবিন। চোখ জ্বলে উঠল একবার দিমিত্রির। চারজনেই সরে এল ওখান থেকে।
ঘরের প্রায় প্রতিটি জিনিসই দেখল ওরা একনজর। একটা দরজার সামনে এসে দাঁড়াল। বল্লম হাতে দাঁড়িয়ে আছে একজন প্রহরী।
ভেতরে ঢুকব, সার্জেন্ট, গম্ভীর হয়ে বলল দিমিত্রি।
জোরে বুট ঠুকে স্যালুট করল প্রহরী। ইয়েস, স্যার! জায়গা ছেড়ে দিয়ে সরে দাঁড়াল এক পাশে।
চাবি বের করল দিমিত্রি। ঢুকিয়ে দিল তালায়।
ঠেলা দিতেই খুলে গেল পেতলের ফ্রেমে আটকানো ভারি কাঠের দরজা। ছোট আরেকটা ঘরে এসে দাঁড়াল চারজনে। ওপাশে আরেকটা দরজা। কম্বিনেশন লক। খুলল ওটা দিমিত্রি। আরেকটা ঘর, উল্টো পাশে আরেকটা দরজা, লোহার গ্রিলের। ওটাও খুলল সে।
ছোট, আট বাই আট ফুট একটা ঘরে এসে দাঁড়াল ওরা। ব্যাংকে মাটির তলায় টাকা রাখার একটা গুদাম যেন। ভল্ট।
একপাশে দেয়াল ঘেঁষে রাখা কাঁচের আলমারি। তাতে রাজপরিবারের গহনাপাতি, মুকুট, রাজদণ্ড, বেশ কিছু নেকলেস এবং আঙটি।
রানীর জন্যে, আঙুটি আর নেকলেসগুলো দেখিয়ে বলল দিমিত্রি। আগেই বলেছি, আমরা ধনী নই। খুব সামান্যই গহনা আছে। ওগুলোকেই ভালমত পাহারা দিয়ে রাখার ব্যবস্থা করেছি আমরা। চল, আসল জিনিস দেখাই।
ঘরের ঠিক মাঝখানে রাখা একটা কাঁচের দেরাজ। ভেতরে সুন্দর একটা স্ট্যাণ্ড। তাতে রূপার চেনে ঝুলছে মাকড়সাটা। চোখে বিস্ময় তিন কিশোরের। একেবারে জ্যান্ত মনে হচ্ছে জিনিসটাকে।