হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল রবিন। আর্মচেয়ারে আরাম করে বসেছিল, এখন সোজা হয়ে গেছে পিঠ, জানালার দিকে চেয়ে আছে। চোখে অবিশ্বাস। জানালার বাইরে একটা ছোট্ট মানুষের মত জীব! মাথায় টোপরের মত টুপি। বিচ্ছিরি দাড়িতে মাটি লেগে আছে, কাঁধে একটা ঝকঝকে গাঁইতি। মুখ ভয়ানক বিকৃত, চোখ লাল।
.
০৫.
রত্নদানো! চেঁচিয়ে বলল রবিন। আমাদের ওপর নজর রাখছিল!
কই, কোথায়! প্রায় একই সঙ্গে বলে উঠল মুসা আর কিশোর।
ওই যে, ওখানে, জানালার বাইরে ছিল! আঙুল তুলে জানালাটা দেখাল। রবিন। চলে গেছে! হয়ত আঙিনায়ই আছে এখনও!
তড়াক করে লাফিয়ে উঠে ছুটল রবিন ও তার পেছনে কিশোর, সবার পেছনে মুসা। দুটো আলমারির মাঝের ফাঁকে একটু অন্ধকার মত জায়গায় রয়েছে। জানালাটা। চোখ মিটিমিটি করে তাকাল রবিন, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখল মসৃণ কাঁচ।
আয়না, বলল কিশোর। প্রতিবিম্ব দেখেছ, রবিন।
ফিরে তাকাল অবাক রবিন। মিস ভারনিয়াও উঠে দাঁড়িয়েছেন। আয়নার উল্টো দিকের একটা জানালা দেখালেন তিনি। আয়নার দিকে আঙুল তুলে বললেন, ওদিকটা অন্ধকার হয়ে থাকে, তাই আয়না বসিয়েছি। জানালার আলো প্রতিফলিত করে।
ছুটে খোলা জানালার কাছে চলে এল ছেলেরা। মাথা বাড়িয়ে বাইরে উঁকি দিল। কিশোর, আঙিনাটা দেখল। কেউ নেই!
কিশোরের পাশে দাঁড়িয়ে মুসাও জানালার বাইরে মাথা বের করে দিল। নাহ্, কেউ নেই আঙিনায়! রবিন, তুমি ঠিক দেখেছিলে তো?
জানালার নিচে তাকাল রবিন, শূন্য থিয়েটার-বাড়ির উঁচু দেয়াল দেখল। কোথাও কিছু নেই। দাড়িওয়ালা রত্নদানোর ছায়াও চোখে পড়ছে না।
আমি ওকে দেখেছি! দৃঢ়কণ্ঠে বলল রবিন। নিশ্চয় বাড়ির আশপাশে কোথাও লুকিয়ে পড়েছে। গেট বন্ধ, বাইরে যেতে পারবে না। খুঁজলে এখনও হয়ত পাওয়া যেতে পারে ওকে।
পাবে না, কারণ ওটা রত্নদানো, বলে উঠলেন মিস ভারনিয়া। জাদুবিদ্যায় ওস্তাদ ওরা।
কিন্তু তবু খুঁজে দেখতে চাই, বলল কিশোর। পেছনে কোন গেট-টেট আছে?
মাথা ঝাঁকাল লেখিকা। তিন গোয়েন্দাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এলেন বাড়ির পেছনের আরেকটা ছোট বারান্দায়। ওখান থেকে আঙিনায় নেমে পড়ল ছেলেরা।
মুসা, তুমি বয়ে যাও, নির্দেশ দিল কিশোর। রবিন, তুমি এস আমার সঙ্গে। ডানে যাব।
তেমন বিশেষ কোন জায়গা নেই, যেখানে লুকিয়ে থাকতে পারেরত্নদানো। আঙিনায় ছোট ছোট কয়েকটা ঝোঁপ। বাড়ির পেছনে কাঠের বেড়া, বেড়ার ওপাশে সরু গলি। বেড়ায় কোন ফোকর নেই, যেখান দিয়ে গলে বেরোতে পারে রত্নদানো। পেছনে একটা গেট আছে, তালাবদ্ধ। পুরানো, মরচে ব্রা লোহার গেট, দেখেই বোঝা যায়, অনেক বছর ধরে খোলা হয়নি। ওই গেট পেরোলেই থিয়েটার-বাড়ির সীমানা।
ওদিক দিয়ে যায়নি, মাথা নাড়ল রবিন।
যত ছোটই হোক, তবু সবকটা ঝোঁপ খুঁজল রবিন আর কিশোর, নিচতলায় ভাঁড়ারের জানালাগুলো পরীক্ষা করল বাইরে থেকে। জানালার পাল্লাগুলো অসম্ভব। নোংরা, দীর্ঘদিন খোলাও হয়নি, পরিষ্কারও করা হয়নি। বাড়ির সামনের দিকে বেড়ার ধারে চলে এল দুজনে। পুরো-বেড়াটা পরীক্ষা করল, কোথাও ফোকর নেই, ঠাসাঠাসি করে দাঁড়িয়ে আছে পাতাবাহারের গাছ। বামন-আকৃতির একটা মানুষেরও আঙিনা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার কোন পথ নেই, একমাত্র গেট ছাড়া।
তাহলে? যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে রত্নদানো!
মুসাও ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে।
চল তো, কিশোর বলল। জানালার নিচে পায়ের দাগ আছে কিনা দেখি।
লাইব্রেরি ঘরের যে জানালায় রত্নদানো দেখেছে রবিন, সেটার নিচে চলে এল তিনজনে। শুকনো কঠিন মাটি, পায়ের ছাপ নেই, পড়েনি।
নেই! দেখতে দেখতে বলল কিশোর। আরেকটা রহস্য!
মানে! ভুরু কুঁচকে প্রশ্ন করল রবিন।
উবু হয়ে মাটি থেকে কিছু তুলে নিল কিশোর। এই যে, দেখ, আলগা মাটি। জুতোর তলা থেকে খসে পড়েছে।
মিস ভারনিয়ার টবের মাটিও হতে পারে, বলল রবিন। কোনভাবে পড়েছে এখানে।
সম্ভাবনা কম, ওপর দিকে চেয়ে আছে কিশোর। জানালাটা দেখ। চৌকাঠের নিচটাও আমাদের মাথার ওপরে। রবিন, খুব ছোট একটা মানুষকে দেখেছিলে, না?
মানুষ না, রত্নদানো! জবাব দিল রবিন, ফুট তিনেক লম্বা! মাথায় টোপরের মত টুপি, নোংরা দাড়ি, কাঁধে ধরে রেখেছে গাঁইতি। ওর কোমর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছিল। এমনভাবে চেয়ে ছিল আমার দিকে, যেন ভীষণ রেগে গেছে।
তা কি করে হয়? নিজেকেই যেন প্রশ্ন করল কিশোর। জানালার চৌকাঠ মাটি থেকে ছয় ফুট উঁচুতে। তিন ফুট লম্বা রত্নদানোর কোমর দেখা যাবে কিভাবে? ওর মাথাই তো দেখা যাওয়ার কথা না!
প্রশ্নটা প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিল রবিন আর মুসাকে।
হয়ত মই, খানিকক্ষণ চুপ করে ভেবে বলল মুসা। হয়ত কেন, নিশ্চয়ই মই!
নিশ্চয়! ব্যঙ্গ প্রকাশ পেল কিশোরের গলায়। ভাঁজ করে এই এত্তোটুকুন করে সেই মই পকেটে ভরে ফেলা যায়! তোমার কি ধারণা? মই পকেটে নিয়ে ফোর্থ ডাইমেনশনের কোন গর্তে ঢুকে পড়েছে দানোটা?
কিশোরের কথার ধরনই অমনি, রাগ করল না মুসা। মাথা চুলকাতে লাগল।
ভ্রুকুটি করল রবিন। ওরা জাদু জানে। জাদুর বলে বাংলাদশে ভানুমতির খেল দেখিয়ে ভ্যানিশ হয়ে গেছে।
আমার মনে হয় আসলে কিছু দেখনি তুমি, রবিন, বলল কিশোর। হয়ত কল্পনা করেছ, মানে, কল্পনার চোখে দেখেছ।
আমি ওটা দেখেছি! জোর দিয়ে বলল রবিন। ওর চোখও দেখেছি! টকটকে লাল, জ্বলন্ত কয়লার মত জ্বলছিল!