খানিকক্ষণ এদিক-ওদিক চেয়ে আবার গাড়ি ছাড়ল বোরিস। থিয়েটারের পর একটা উঁচু পাতাবাহারের বেড়া পেরিয়ে এল। পলকের জন্যে বেড়ার ওপাশে, অন্ধকার, সরু লম্বা একটা দালান চোখে পড়ল কিশোরের। বেড়ার পরে আরেকটা বাড়ি, একটা ব্যাংক, পুরানো ধাচের বাড়ি, পাথরে তৈরি দেয়াল।
আরেকটা ব্লকের কাছে চলে এল ট্রাক। এখানে একটা সুপারমার্কেট, দোকানগুলো পুরানো। অনেক আগে এটা বাণিজ্যিক এলাকা ছিল, বোঝাই যাচ্ছে।
বাড়িটা পেছনে ফেলে এসেছি, ব্যাংক আর সুপারমার্কেটের মাঝখানে বসানো পাথর ফলকে রাস্তার নাম্বার দেখে বলল কিশোর।
বেড়ার ওপাশের বাড়িটাই হবে, রবিন বলল। একমাত্র ওটাকেই বসতবাড়ির মত দেখতে লাগছে।
পিছিয়ে নিয়ে গিয়ে কোথাও পার্ক করুন, বোরিসকে বলল কিশোর।
খানিকটা পিছিয়ে এনে পাতাবাহারের বেড়ার ধারে গাড়ি পার্ক করল বোরিস। ছয় ফুট উঁচু গাছগুলো অযত্নে বেড়ে উঠেছে, মাথা সবগুলোর সমান নয়, রাস্তার ধুলোবালিতে আসল রঙ হারিয়ে গেছে রঙিন পাতার। বেড়ার ওপাশে পুরানো। বাড়িটার দিকে আবার তাকাল কিশোর, মনে হল, বাইরের ব্যস্ত দুনিয়া থেকে অনেক দূরে সরে আছে ওটা।
বেড়ার ধার ধরে হেঁটে গেল মুসা। খানিকটা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল সাদা রঙ করা ছোট একটা গেটের সামনে। চেঁচিয়ে উঠল, আরে, এই তো! মিস শ্যানেল। ভারনিয়া!
মুসার পাশে এসে দাঁড়াল কিশোর আর রবিন।
এটা একটা জায়গা হল! বলল মুসা। দুনিয়ায় এত জায়গা থাকতে এই ভূতের গলিতে এসে বাসা বাঁধলেন কেন মহিলা!…আরিসব্বোনাশ! কাণ্ড দেখেছ! আঙুল তুলে গেটের এক জায়গায় সাঁটানো কাগজ দেখাল সে। যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্যে কাঁচ দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে, কিন্তু তবু রোদে হলদেটে হয়ে গেছে সাদা মোটা কাগজ। বিড়বিড় করে পড়ল মুসা, মানুষ হলে বেল বাজান, প্লীজ। রত্নদানো, বামন কিংবা খাটোভূত হলে শিস দাও। সেরেছে, কিশোর, পাগল! পাগলের পাল্লায় পড়তে যাচ্ছি! চল, ভাগি!
ভুরু কুঁচকে লেখাটার দিকে চেয়ে আছে কিশোর। বোঝা যাচ্ছে, ওই সব কল্পিত জীবগুলোর অস্তিত্ব বিশ্বাস করেন মিস ভারনিয়া। মুসা, এক কাজ কর, শিস দাও…
ফিক করে হেসে ফেলল রবিন।
কী! চেঁচিয়ে উঠল মুসা! আমি কি রত্নদানো নাকি?
রত্নদানো না হলেও পেটুকদানো, এতে কোন সন্দেহ নেই। যা বলছি, কর। শিস দাও। দেখা যাক, কি ঘটে।
কিশোর ঠাট্টা করছে না বুঝতে পেরে আর প্রতিবাদ করল না মুসা। ঠোঁট গোল করে টানা তীক্ষ্ণ শিস দিয়ে উঠল।
বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। পাতাবাহারের ঝোঁপের ভেতরে কথা বলে। উঠল কেউ, কে?
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপারটা বুঝতে পারল কিশোর। ঝোঁপের ভেতরে স্পীকার লুকিয়ে রাখা হয়েছে। বাড়ির ভেতরে বসে স্পীকারের মাধ্যমে কথা বলছে কেউ। বড় বড় এলাকা নিয়ে লস অ্যাঞ্জেলেসে যে সব বাড়ি তৈরি হচ্ছে আজকাল, অনেক বাড়িতেই এই স্পীকারের ব্যবস্থা রয়েছে। এগিয়ে গিয়ে উঁকি দিল ঝোঁপের ভেতরে। কিছু দেখা গেল না। দুহাতে পাতা আর ডাল সরাতেই দেখা গেল জিনিসটা। পাখি। পোষার ছোট বাক্সে বসানো হয়েছে স্পীকার, বৃষ্টি থেকে রক্ষা করার জন্যে। মাইক্রোফোন বসানো রয়েছে স্পীকারের পাশেই।
গুড আফটারনুন, মিস ভারনিয়া, মার্জিত গলায় বলল কিশোর। আমরা তিন গোয়েন্দা। মিস্টার ক্রিস্টোফার পাঠিয়েছেন। আপনার সমস্যা নিয়ে কথা বলতে এসেছি আমরা।
ও, নিশ্চয় নিশ্চয়! তালা খুলে দিচ্ছি, মিষ্টি হালকা গলা।
গেটে মৃদু গুঞ্জন উঠল। বাড়ির ভেতরে বসেই নিশ্চয় সুইচ টেপা হয়েছে, মেকানিজম কাজ করতে শুরু করেছে পাল্লার, খুলে গেল ধীরে ধীরে।
আগে ভেতরে ঢুকল কিশোর। তার পেছনে মুসা আর রবিন।
পেছনে গেটটা আবার বন্ধ হয়ে যেতেই থমকে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা। ওদের মনে হল, বাইরের জগৎ থেকে আলাদা হয়ে গেল যেন। মাথা ছাড়িয়ে উঠে গেছে ছয় ফুট উঁচু বেড়া, রাস্তা দেখা যায় না। একপাশে পরিত্যক্ত থিয়েটার-বাড়ির পুরানো দেয়াল উঠে গেছে কয়েক তলা সমান উঁচুতে। আরেক পাশে ব্যাংকের গ্ল্যানেট পাথরের দেয়াল। দেয়াল বেড়া সবকিছু মিলে সরু পুরানো বাড়িটাকে গিলে ফেলার চেষ্টা চালাচ্ছে যেন। বাড়িটা তিনতলা, কিছু কিছু ঘরের দেয়াল রেডউড কাঠে তৈরি, কড়া রোদ বিবর্ণ করে দিয়েছে কাঠের রঙ। নিচের তলায় সামনের দিকে বারান্দা, কয়েকটা টবে লাগানো ফুল গাছে ফুল ফুটেছে, পুরো এলাকাটায়। তাজা উজ্জ্বল রঙ বলতে শুধু ওই ফুল কটাই।
একই সময়ে প্রায় একই অনুভূতি হচ্ছে তিনজনের। বাড়িটা দেখতে দেখতে ওদের মনে হল, রূপকথার পাতা থেকে উঠে এসেছে যেন কোন ডাইনীর বাড়ি।
কিন্তু মিস শ্যানেল ভারনিয়াকে মোটেই ডাইনীর মত লাগল না। সদর দরজা খুলে দাঁড়িয়েছেন। লম্বা, পাতলা শরীর, চঞ্চল চোখ, সাদা চুল।
এস, পাখির গলার মত মোলায়েম মিষ্টি কণ্ঠস্বর মিস ভারনিয়ার। তোমরা। আসাতে খুব খুশি হয়েছি। এস, ভেতরে এস।
লম্বা হলঘর পেরিয়ে বড়সড় লাইব্রেরিতে ছেলেদেরকে নিয়ে এলেন লেখিকা। দেয়াল ঘেঁষে বড় বড় আলমারি, বুক-শেলফ, বই উপচে পড়ছে। দেয়ালের জায়গায়। জায়গায় ঝোলানো রয়েছে সুন্দর পেইন্টিং আর ফটোগ্রাফ, সবই বাচ্চা ছেলেমেয়ের।
বস, তিনটে চেয়ার দেখিয়ে বললেন লেখিকা। হ্যাঁ, যে জন্যে ডেকেছি। তোমাদেরকে, কোনরকম ভূমিকা না করে শুরু করলেন তিনি। রত্নদানোরা বড় বিরক্ত করছে আমাকে। কয়েকদিন আগে পুলিশকে জানিয়েছিলাম, আমার দিকে যে-রকম করে তাকাল, রত্নদানোর কথা বলতে আর কোনদিন যাব না ওদের কাছে…।