পায়ে পায়ে চারপাশ থেকে এগিয়ে আসতে শুরু করল চার বামন।
বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন কিশোরের দেহে। ছোঁ মেরে বেল্টটা তুলে নিয়েই লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল টেবিলে। স্কাইলাইটের ওপাশে আটকানো দড়ির সিঁড়ি টেনে নামল। চেচিয়ে বলল, মিরো, জলদি!
দড়ির সিঁড়ি বেয়ে ট্রেলারের ছাতে উঠে গেল মিরো। বেল্টটা তার হাতে দিয়ে মুসা আর রবিনের দিকে তাকাল কিশোর। তোমরাও ওঠ!
বিনা প্রতিবাদে ছাতে উঠে গেল দুই সহকারী গোয়েন্দা। তাদের ঠিক পর পরই উঠে পড়ল কিশোরও।
টেবিলে উঠে পড়েছে দুই বামন, একজন ইতিমধ্যেই সিঁড়ি ধরে ফেলেছে।
ট্রেলারের ছাতে আটকা পড়েছে চার কিশোর। কোনদিকে যাওয়ার পথ দেখা। যাচ্ছে না। ওদিকে ছুরি হাতে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করেছে এক বামন।
কোন্ দিক দিয়ে কিভাবে সরে যাবে, আগেই ভেবে রেখেছে যেন কিশোর। ট্রেলারের গায়ে ঠেকিয়ে রাখা হয়েছে পুরানো একটা স্লিপার, বাচ্চাদের কোন পার্ক থেকে কিনে এনেছেন রাশেদ চাচা। লোহার কয়েকটা মোটা মোটা কড়ি আড়াআড়ি পড়ে আছে স্লিপারের ওপর।
একমুহূর্ত সময় নষ্ট করল না কিশোর। নিচের দিকে পা দিয়ে উপুড় হয়ে। স্লিপারে শুয়ে পড়ল। শ করে কড়ির তলা দিয়ে নেমে চলে এল কাঠের গুড়োয় ঢাকা মাটিতে। ডেকে সঙ্গীদেরকেও নামতে বলল। কিশোরের মতই একে একে নেমে এল মিরো, রবিন, মুসা। জঞ্জালের ভেতর দিয়ে পথ করা আছে, তাতে ঢুকে পড়ল চারজনে।
স্লিপারে আড়াআড়ি করে কড়ি রাখা আছে, এটা জানে না বামনেরা। অন্ধকারে ভাল দেখতেও পেল না। তাই শুয়ে না নেমে স্লিপারে বসে পড়ল এক বামন। শা করে খানিকটা নেমেই থ্যা করে বাড়ি খেল কড়িতে, আটকে গেল তার শরীরে, রাতের অন্ধকার চিরে দিল তার তীক্ষ্ণ চিৎকার।
এদিক দিয়ে নয়! চেঁচিয়ে সঙ্গীদেরকে বলল বামনটা। বেরিয়ে যাও! ঘুরে এসে ধর বিচ্ছুগুলোকে! ওরা বেরিয়ে যাচ্ছে!
ছাতে হুড়োহুড়ির শব্দ হল। স্কাইলাইট দিয়ে টপাটপ আবার ট্রেলারের ভেতরে লাফিয়ে নামল বামনগুলো। সবচেয়ে সহজ পথ সহজ তিন দিয়ে বেরোবে।
ওদের ধরতেই হবে! চেঁচিয়ে বলল আবার কড়িতে আটকাপড়া বামনটা। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে আবার স্লিপার বেয়ে ছাতে উঠে যাওয়ার চেষ্টা করছে সে। বেল্টটা নিয়ে গেছে বিচ্ছুগুলো!
অনেকগুলো কাঠের গুঁড়িতে ঘেরা ছোট্ট একটুখানি খোলা অন্ধকার জায়গায় গাদাগাদি করে বসেছে ছেলেরা।
তীক্ষ্ণ হুইসেল বেজে উঠল হঠাৎ। সে-রাতে দ্বিতীয়বার চমকাল রবিন আর মুসা। পুলিশের হুইসেল। মাথা তুলে দেখল, প্রায় আধডজন ছায়ামূর্তি ছুটে আসছে ইয়ার্ডের আঙিনা ধরে।
মিনিটখানেক হুটোপুটির শব্দ হল, পুলিশের উত্তেজিত কণ্ঠ আর বামনদের তীক্ষ্ণ চেঁচামেচি শোনা গেল। ইতিমধ্যে তিন সঙ্গীকে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। কিশোর।
চার বামনকেই ধরে ফেলেছে পুলিশ। পুলিশের সঙ্গে মিস্টার টোহা মুচামারুও রয়েছেন।
বন্দীদেরকে হাতকড়া পরিয়ে গাড়িতে ভোলা হল।
বাবার কাছে এসে দাঁড়াল মিরো। দেখলে তো, বাবা, কিশোর-স্যানের বুদ্ধি? তুমি তো পাত্তাই দিচ্ছিলে না, অথচ গোল্ডেন বেল্ট খুঁজে বের করল সে, অপরাধীদের ধরিয়ে দিল।
আয়্যাম সরি, কিশোর, লজ্জিত কণ্ঠে বললেন মুচামারু। তোমাদেরকে…
আরে না না, কি যে বলেন, স্যার, তাড়াতাড়ি বলল কিশোর।
যা-ই বল, কিশোর, অসাধ্য সাধন করেছ তোমরা। পুলিশই হাল ছেড়ে দিয়েছিল…মিরোর কথা না শুনলে যে কি ভুল করতাম! এক ভুল তো করেছিলাম তোমাদেরকে মিউজিয়ম থেকে বের করে দিয়ে!
এই যে, বাবা, বেল্টটা নাও, মুচামারুর হাতে গোল্ডেন বেল্ট তুলে দিল, মিরো।
তিন গোয়েন্দাকে বার বার ধন্যবাদ জানিয়ে মিরোকে নিয়ে গাড়িতে গিয়ে উঠলেন মিস্টার মুচামারু।
লস অ্যাঞ্জেলেস পুলিশের চীফ ইয়ান ফ্লেচার আরও কিছুক্ষণ দেরি করলেন, কিছু প্রশ্ন করলেন কিশোরকে। তারপর তিনিও গিয়ে গাড়িতে উঠলেন। চলে গেল পুলিশের গাড়ি।
কিশোর! এইবার ধরল মুসা। কি করে এসব ঘটল কিছুই তো বুঝতে পারছি।! ওই বামনগুলোই তো রত্নদানো সেজেছিল, না?
হ্যাঁ, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। ইবলিস একেকটা।
গোল্ডেন বেল্ট কি ওরাই চুরি করেছিল?
তো আর কারা? কাব স্কাউট সেজে ঢুকেছিল মিউজিয়মে। রবিন সোনার দাঁতটার কথা না বললে কিছুই বুঝতে পারতাম না। গোল্ডেন বেল্ট নিয়ে হাওয়া হয়ে যেত ব্যাটারা।
.
১৯.
অনেকদিন পর আবার মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের অফিসে ঢুকেছে তিন গোয়েন্দা। বিশাল টেবিলের ওপাশে বসে আছেন বিখ্যাত চিত্রপরিচালক। আগের মতই রয়েছে ঘরের পরিবেশ, কোন কিছু বদলায়নি এতটুকু।
মোটাসোটা ফাইলটা পরিচালকের দিকে ঠেলে দিল রবিন।
ফাইলে ডুবে গেলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। অনেকক্ষণ পর মুখ তুলে বললেন, চমৎকার! আবার কৃতিত্ব দেখালে তোমরা।
লজ্জিত হাসি হাসল রবিন আর মুসা। কিশোরের মুখ লালচে হয়ে উঠল।
বামনরাই তাহলে রত্নদানো সেজেছিল, আপনমনেই বললেন পরিচালক। ওদের সঙ্গে ভাব করেছে বব, এটা জানার পর ভারনিয়ার চেহারা কেমন হয়েছিল দেখতে ইচ্ছে করছে।
প্রথমে রেগে গিয়েছিলেন, বলল কিশোর। বব অবশ্য জানত না, তাকেও ফাঁকি দিয়েছে বার্ট। ব্যাংক ডাকাতির ব্যাপারটা জানলে বব রাজি হত না কিছুতেই। খুব লজ্জা পেয়েছে সে, হাতে-পায়ে ধরে মাপ চেয়েছে ফুফুর, কাছে। মাপ করে দিয়েছেন মিস ভারনিয়া। তিনি ঠিক করেছেন, বাড়ি বেচে দিয়ে সাগরের পারে কোথাও একটা ছোট কটেজ কিনবেন। পুরানো বাড়িতে আর থাকবেন না।