গোপন পথগুলো দিয়ে বার বার ঢুকল-বেরোল দুই সহকারী গোয়েন্দা। দুজনেই একমত হল, সবচেয়ে সহজে সবচেয়ে কম সময়ে ঢাকা কিংবা বেরোনো যায় সহজ তিন দিয়ে।
.
১৮.
রাতের খাবারের সময় হল, কিশোরের দেখা নেই। আরও এক ঘণ্টা দেরি করে ফিরল সে, উত্তেজিত কিন্তু হাসি হাসি চেহারা। রবিন আর মুসা দেখে অবাক হল, সুকিমিচি কোম্পানির গাড়িতে করে নয়, ট্যাক্সি নিয়ে এসেছে গোয়েন্দাপ্রধান। গাড়ি থেকে মিরোকে চুপিচুপি নামতে দেখে আরও অবাক হল দুই সহকারী গোয়েন্দা।
মিরোকে নিয়ে বাড়ির পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকল কিশোর, কেউ দেখে ফেলবে এই, ভয় যেন করছে।
এই যে, এসেছ! বলে উঠলেন মেরিচাচী। কিশোর, এত দেরি কুলি কেনরে? আমরা এদিকে ভেবে মরি। দেখ, চেহারার কি ছিরি করে এসেছে! আরে, এই, কিশোর, জ্যাকেটের বোতাম লাগাতেও তোর কষ্ট হয় নাকি? কোমরের কাছে। লাগাস না কেন? বিচ্ছিরিভাবে ঝুলে আছে।
মিরোকে একটা চেয়ার দেখিয়ে নিজে আরেকটাতে বসে বলল কিশোর, আস্তে, চাচী, আস্তে। একসঙ্গে এতগুলো প্রশ্ন করলে কোনটার জবাব দেব?
এই যে, বসে পড়লি তো? কোথায় কোথায় ঘুরে এসেছে কে জানে! হাতে মুখে ময়লা-যা, জলদি ধুয়ে আয় ভাল করে।
মিরোকে নিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে এল কিশোর।
খেতে খেতে মুখ তুললেন রাশেদ চাচা। কিশোর, আবার কিসে জড়িয়েছ? তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, আর কখনও ডাকাতদের সঙ্গে মিশবে না। বস্তায় ভরে এবারই তো দিয়েছিল সাগরে ফেলে। ভাগ্যিস রবিন গিয়েছিল…খবরদার, ডাকাতির কেস আর কখনও নেবে না।
গেছিলাম তো রত্নদানো ধরতে, ডাকাতের পাল্লায় পড়ব তা কি আর জানি? বসতে অসুবিধে হচ্ছে যেন কিশোরের। খালি নড়ছে, একবার এভাবে বসছে, একবার, ওভাবে।
হুমম! জবাব খুঁজে পাচ্ছেন না রাশেদ চাচা। ভাজা গরুর মাংসে ছুরি চালালেন, কাঁটা চামচ দিয়ে এক টুকরো মুখে ফেলে চিবাতে চিবাতে বললেন, তা এখন আবার কি ধরে এলে? জিন, না পরী?
মিরোকে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম, জাপানী কিশোরের কাঁধে হাত রাখল গোয়েন্দাপ্রধান। বড় বিপদে পড়েছেন ওর বাবা। একটা বেল্ট চুরি হয়েছে, ওটা খুঁজে বের করতে গিয়েছিলাম।
গোল্ডেন বেল্টের কথা বলছ? চিবানো থেমে গেছে রাশেদ চাচার। পারবে বের করতে? আমি অনেক ভেবেছি, কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারিনি কোন দিক দিয়ে কিভাবে ওটা বের করে নিয়ে গেল চোরেরা।
মাথা ঝাঁকাল শুধু কিশোর, কি বোঝাতে চাইল সে-ই জানে।
এরপর আর বেশি কথাবার্তা হল না। খাওয়া শেষ হল।
অনেক প্রশ্ন ভিড় করে আছে রবিনের মনে, কিন্তু কিশোরকে জিজ্ঞেস করার সুযোগই পেল না। কেমন যেন ঝিম মেরে বসে আছে গোয়েন্দাপ্রধান। আরেকটা ব্যাপার, এই গরমের বিকেলে জ্যাকেট পরে আছে কেন সে? মেরিচাচী বলায়। কোমরের কাছের বোতাম লাগিয়েছে, টান টান হয়ে আছে জায়গাটা। হঠাৎ কি করে এত চর্বি জমে গেল তার পেটে!
অন্ধকার নামতে শুরু করতেই উঠে দাঁড়াল কিশোর। রবিন, মুসা, চল। হেডকোয়ার্টারে যাই।
ম্যাগাজিন পড়ছেন রাশেদ চাচা, ডিশ-প্লেট ধুচ্ছেন চাচী। চুপচাপ বেরিয়ে এল ছেলেরা।
হেডকোয়ার্টারে ঢুকেই দুই সহকারীকে জিজ্ঞেস করল কিশোর, যা বলেছিলাম করেছ?
মাথা ঝাঁকাল মুসা আর রবিন।
করা উচিত হয়নি, বলল মুসা। রাস্তার ওপাশে কয়েকটা ছেলে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিল, আমাদেরকে দেখেছে। গোপন পথগুলো দেখে ফেলেছে ওরা।
আমাদের ওপর চোখ রাখার জন্যে শুঁটকিই হয়ত পাঠিয়েছে, রবিন বলল। আমারও মনে হয় কাজটা উচিত হয়নি, তুমি বললে বলেই করলাম।
ঠিকই করেছ, সন্তুষ্ট মনে হল কিশোরকে। আমারও সময় খুব ভালই কেটেছে, পরে বলব সব। এস, এখন আমাদের কোন একটা অভিযানের কথা শোনাও মিরোকে। ও শুনতে চায়।
আগ্রহী শ্রোতা পাওয়া গেছে, খুশি হয়েই গল্প শুরু করল রবিন।
বাইরে অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। মাথার ওপরের স্কাইলাইটের ঢাকনা হাঁ করে খুলে দিয়েছে কিশোর, তারাজ্বলা কালো আকাশ চোখে পড়ছে।
ফিসফিস-করে-কথাবলা-মমির গল্প সবে মাঝামাঝি এসেছে, এই সময় নড়েচড়ে উঠল কিশোর। এক এক করে বোতাম খুলল, গা থেকে খুলে ফেলল জ্যাকেট। শার্টের নিচের দিকটা তুলে দেখাল দুই সহকারীকে।
প্রফেসর বলতে যাচ্ছিল রবিন, কিন্তু প্রফে বলেই থেমে গেল। অস্ফুট একটা শব্দ করে উঠল মুসা। দুজনেরই চোখ বড় বড় হয়ে গেছে।
কিশোরের কোমরে সম্রাটের সোনার বেল্ট!
বড় বড় চারকোনা সোনার টুকরো, তাতে উজ্জ্বল পাথর বসানো। না, কোন ভুল নেই, গোল্ডেন বেল্টই পরে আছে গোয়েন্দাপ্রধান।
ভীষণ ভারি! নড়েচড়ে বসল কিশোর। পরে রাখতে খুব কষ্ট হচ্ছে। কোমর থেকে বেল্ট খুলে টেবিলে রাখল সে।
মুখে খই ফুটল দুই সহকারীর। নানা প্রশ্ন। বেল্টটা কোথায় পেয়েছে কিশোর? পরে রয়েছে কেন? কেন কর্তৃপক্ষকে ফেরত দেয়নি? কেন…
হঠাৎ ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দুই সুড়ঙ্গের ঢাকনা। খুদে কুৎসিত একটা মানুষের মুখ দেখা দিল। পরক্ষণেই ভেতরে উঠে এল মানুষটা। হাতে ইয়াবড় এক ছুরি। জ্বলন্ত চোখে ছেলেদের দিকে চেয়ে ভয়াবহ ভঙ্গিতে ছুরি চাল সে। ঠিক সেই মুহূর্তে খুলে গেল লাল কুকুর চার-এর-দরজা। ছুরি হাতে ঢুকল আরেকজন খুদে মানুষ। খুলে গেল সহজ তিন, দেখা গেল আরেকটা মুখ, সেটার পেছনে আরেকটা।
বিচ্ছুরা, তীক্ষ্ণ গলায় চেঁচিয়ে উঠল এক আগন্তুক, এবার ভালয় ভালয় বেল্টটা দিয়ে দাও তো!