সাঁইত্রিশ? বুড়ো আঙুল দিয়ে পেছন দিকে দেখাল অফিসার, রবিনরা যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে।-তিনটে ব্লক পেছনে। না না, গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না, এটা ওয়ান ওয়ে। সামনে চার ব্লক যেতে হবে সোজা, ডানে মোড় নিয়ে—
অফিসারের কথা শেষ হওয়ার আগেই এক কাণ্ড করল বোরিস। গ্যাস প্যাড়ালে পায়ের চাপ বাড়িয়ে বনবন করে স্টিয়ারিং ঘোরাল। প্রচণ্ড গর্জন করে উঠল ইঞ্জিন, দুই চাকার ওপর ভর দিয়ে আধ চক্কর ঘুরে গেল গাড়ি, টায়ার ঘষা খাওয়ার তীক্ষ্ণ কর্কশ আওয়াজ উঠল, পরক্ষণেই খেপা ঘোড়ার মত লাফ দিয়ে আগে বাড়ল। ট্রাকটা। তীব্র গতিতে ছুটে চলল যেদিক থেকে এসেছিল সেদিকে।
হেইই! বেআইনী… চেঁচিয়ে উঠল অফিসার, মাত্র দুটো শব্দ রবিনের কানে ঢুকল, বাকিটা ঢাকা পড়ে গেল ইঞ্জিনের শব্দে।
দেখতে দেখতে তিনটে ব্লক পেরিয়ে এল ট্রাক।
মোড় নিন! মোড় নিন! আঙুল তুলে দেখাল রবিন। পথের মোড়ে খাটো একটা সাইনবোর্ড, তাতে ৩৭ নাম্বার লেখা, তলায় তীর চিহ্ন দিয়ে দেখানো হয়েছে। কোনদিকে যেতে হবে।
আবার টায়ারের কর্কশ আর্তনাদ তুলে মোড় নিল ট্রাক। সামনে জেটিতে ঢোকার গেট ভারি লোহার পাতের ফ্রেমে মোটা তারের জাল লাগিয়ে তৈরি হয়েছে। পাল্লা।
সবুজ ভ্যানটা পানির প্রায় ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। সামনের বাম্পারের ঠিক পেছনে গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে সাদা রুমাল নাড়ছে একজন লোক। জেটি থেকে মাত্র শখানেক গজ দূরে একটা লঞ্চ, দ্রুত এগিয়ে আসছে এদিকেই।
দরজায় তালা! ট্রাকের গতি কমাল বোরিস।
পেছনে সাইরেনের শব্দ। ট্রাকের পাশ দিয়ে শা করে বেরিয়ে কয়েক গজ সামনে গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ল পুলিশের গাড়িটা।ঝটকা দিয়ে খুলে গেল একপাশের দরজা। রিভলভার হাতে লাফিয়ে নেমে এল পুলিশ অফিসার। ছুটে এল ট্রাকের দিকে।
ট্রাক থামিয়ে দিয়েছে বোরিস। তার পাশে এসে হাত বাড়াল অফিসার, ইউ আর আণ্ডার অ্যারেস্ট! ওয়ান ওয়েতে ইউ টার্ন নিয়েছ, বেআইনীভাবে গতি বাড়িয়েছ। দেখি, লাইসেন্স দেখি?
সময় নেই, অফিসার, আপনি বুঝতে পারছেন না! চেঁচিয়ে বলল বোরিস। জলদি সাঁইত্রিশ নাম্বারে ঢুকতে হবে…
…লোডিং আজ বন্ধ, বোরিসকে থামিয়ে দিয়ে বলল অফিসার। ধানাই পানাই বাদ দাও। লাইসেন্স দেখি।
বোরিসের কাঁধের ওপর দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দিল রবিন। অফিসার, সত্যিই বুঝতে পারছেন না আপনি! ওই ভ্যানে দুটো ছেলেকে কিডন্যাপ করা হয়েছে! প্লীজ, সাহায্য করুন আমাদেরকে!
ওসব কিচ্ছা-কাহিনী বাদ দাও, খোকা, সবুজ ভ্যানটার দিকে একবার চেয়েই মুখ ফিরিয়ে নিল অফিসার। ওসব অনেক শোনা আছে, বোরিসের দিকে চেয়ে। বলে উঠল, কই, লাইসেন্স কই?
প্রতিটি সেকেণ্ড এখন মূল্যবান, দ্রুত এগিয়ে আসছে লঞ্চ, কিন্তু অফিসারকে বোঝানো যাচ্ছে না সেটা। মরিয়া হয়ে চেঁচিয়ে উঠল রবিন, বোরিস, গেট ভেঙে ঢুকে যান! যা হয় হবে!
এমন কিছুই একটা বোধহয় ভাবছিল বোরিস, রবিনের কথা শেষ হওয়ার আগেই সামনে লাফ দিল ট্রাক। পেছনে চেঁচিয়ে উঠল অফিসার, কানেই তুলল না ব্যাভারিয়ান।
ভয়ঙ্কর গতিতে এসে গেটের পাল্লায় সামনের বাম্পার দিয়ে আঘাত হানল। ট্রাক। তীক্ষ্ণ বিচিত্র শব্দ তুলে প্রতিবাদ জানাল যেন পাল্লা, পরক্ষণেই বাঁকাচোরা হয়ে ছিঁড়ে ভেঙে খুলে এল কজা থেকে, ট্রাকের বাম্পারে আটকে থেকে কয়েক গজ এগোল, তারপর খসে পড়ল পথের ওপর। পাল্লা মাড়িয়েই এগোনর চেষ্টা করল। ট্রাক, কিন্তু পারল না। তারের জাল আর বাকাচোরা ইস্পাতের পাত জড়িয়ে ফেলল সামনের দুই চাকা। কান-ফাটা শব্দ করে ফেঁসে গেল একটা টায়ার। এখনও সবুজ ভ্যানটা রয়েছে পঞ্চাশ ফুট দূরে।
রবিন, এস! বলতে বলতেই এক ঝটকায় কেবিনের দরজা খুলে লাফিয়ে পথে নামল বোরিস। ছুটল।
দড়ি ছেঁড়া পাগলা ষাঁড়ের মত এসে বার্টের ঘাড়ে পড়ল বিশালদেহী ব্যাভারিয়ান। চমকে উঠে পকেটে হাত দিতে গেল ডাকাতটা, বোধহয় পিস্তল বের করার জন্যে, কিন্তু পারল না। তার আগেই দুহাতে ধরে তাকে মাথার ওপর তুলে। পানিতে ছুঁড়ে ফেলে দিল বোরিস।
দ্রুত সামলে নিল বার্ট। গতিক সুবিধের নয় বুঝে গেছে, সোজা লঞ্চের দিকে সাঁতরাতে শুরু করল সে।
ভ্যান থেকে বেরিয়ে এল রিক আর জিম, একজনের হাতে একটা রেঞ্চ, আরেকজনের হাতে টায়ার খোলার লীভার। একই সঙ্গে আক্রমণ চালাল বোরিসের ওপর।
ঝট করে বসে দুজনের আঘাত প্রতিহত করল বোরিস, আবার সোজা হয়ে উঠে খপ করে ধরে ফেলল দুই ডাকাতের অস্ত্র ধরা দুই হাত, প্রায় একই সঙ্গে।
কব্জিতে প্রচণ্ড মোচড় খেয়ে চেঁচিয়ে উঠল রিক আর জিম। হাত থেকে খসে পড়ল অস্ত্র। ঘাড় ধরে জোরে দুজনের মাথা ঠুকে দিল বোরিস। তারপর ঠেলে নিয়ে গিয়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল পানিতে।
রবিন বসে নেই। ভ্যানের পেছনের খোলা দরজায় দাঁড়িয়ে ডাকল, মুসাআ! কিশোরও!
রবিন! বস্তার ভেতর থেকে শোনা গেল কিশোরের ভোঁতা কণ্ঠ। জলদি বের কর আমাদেরকে!
রবিন! জলদি, আর পারছি না! ওফ, বাবারে! প্রায় কেঁদে ফেলল মুসা। কিভাবে যেন গড়িয়ে এসে তার পেটের ওপরে পড়েছে কিশোর।
ওদিকে, জিম আর রিকও বার্টের পিছু নিয়েছে। তিনজনকেই তুলে নিয়ে নাক ঘোরাল লঞ্চ। দ্রুত ছুটল কয়েকশো গজ দূরের বড় একটা মাছধরা জাহাজের দিকে।