থরথর করে কেঁপে উঠল ট্রাক, নাক সোজা রাখতে পারছে না যেন কছুতেই। স্টিয়ারিঙে চেপে বসেছে বোরিসের আঙুল, ফুলে উঠেছে হাতের শিরা। অনেক কষ্টে ট্রাকটাকে সাইডরোডে নামিয়ে আনল সে, থামিয়ে দিল।
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছছে বোরিস। টায়ার ফেটে গেছে!
ঢিল হয়ে গেল রবিনের স্নায়ু। হেলান দিয়ে বসল, দুহাত ছড়িয়ে পড়ল। দুদিকে। শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে রইল সবুজ ভ্যানটার দিকে, দ্রুত ছোট হয়ে যাচ্ছে ওটা।
১৬.
যত তাড়াতাড়ি পারল, টায়ার বদলে নিল বোরিস। কিন্তু তাতেও দশ মিনিটের বেশি লেগে গেল। ইতিমধ্যে নিশ্চয় কয়েক মাইল এগিয়ে গেছে ভাটা।
অদ্ভুত এক শূন্যতা অনুভব করছে রবিন। কেন যেন তার মনে হল, কিশোর আর মুসাকে আর কোনদিন দেখতে পাবে না।
রবিন, এখন কি করা? ড্রাইভিং সিটে রবিনের পাশে উঠে বসেছে আবার বোরিস। পুলিশের কাছে যাব?
কি হবে? ভ্যানের লাইসেন্স নাম্বার নিতে ভুলে গেছি আমি, একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছে রবিন। পুলিশকে কি বলব?
কি যেন ভাবল বোরিস। সোজা পথ। ভ্যানটা যেদিকে গেছে সেদিকেই যাই, বলতে বলতেই ইঞ্জিন স্টার্ট দিয়ে গিয়ার দিল সে। নির্জন হাইওয়ে ধরে ট্রাক ছোটাল। আবার পশ্চিমে।
গ্রাভ কম্পার্টমেন্ট থেকে লস অ্যাঞ্জেলেসের একটা ম্যাপ বের করল রবিন। তাতে দেখল, কয়েক মাইল সামনে এক জায়গায় পথটা দুভাগ হয়ে গেছে। একটা শাখা চলে গেছে সুন্দর সৈকত শহর লং বীচ-এর দিকে। আরেকটা শাখা গেছে স্যান পেড্রোতে।
রেডিওতে একটা বন্দরের কথা বলা হয়েছে। লং বীচে বন্দর নেই, স্যান পেড্রোতে আছে। তারমানে ওদিকেই গেছে ভ্যানটা।
বোরিস, স্যান পেড্রোর দিকে যেতে হবে, বলল রবিন।
হোকে, একমনে গাড়ি চালাচ্ছে ব্যাভারিয়ান।
পুরানো ইঞ্জিনের শক্তি নিঙড়ে যত জোরে সম্ভব ছুটে চলেছে ট্রাক। মগজে। ভাবনার ছুরি চালাচ্ছে রবিন, কিন্তু কিছুতেই বুঝতে পারছে না রত্নদানো খুঁজতে গিয়ে ডাকাতদের হাতে পড়ল কি করে মুসা আর রবিন! তাদেরকে বস্তায় ভরে নিয়ে যাচ্ছে কেন মৃরিশ থিয়েটারের দারোয়ান বার্ট ইঅং! বেশিক্ষণ ভাবনা-চিন্তার সময়। পেল না সে, দুই রাস্তার মোড়ে পৌঁছে গেল ট্রাক।
স্যান পেড্রোর রাস্তায় গাড়ি নামিয়ে আনল বোরিস। গতি সামান্য শিথিল করতে হয়েছিল, আবার বাড়িয়ে দিল।
শিগগিরই স্যান পেড্রোর সীমানা দেখা গেল দূর থেকে। রাস্তার দুপাশে বিস্তীর্ণ মাঠে কালো কালো অসংখ্য বিন্দু দেখা যাচ্ছে। কাছে এলে বোঝা গেল ওগুলো কি। ডেরিক। কুৎসিত দানবের মত দাঁড়িয়ে আছে বিশাল কালো যন্ত্রগুলো, মাটির তলা থেকে তেল ভোলার জন্যে বসানো হয়েছে।
বন্দরে এসে ঢুকল ট্রাক। তেলমেশানো ঘোলা পানিতে গাদাগাদি করে ভাসছে। ছোট-বড়-মাঝারি অগুনতি জলযান। নানারকম জাহাজের মাঝে মাঝে রয়েছে মাছ। ধরার নৌকা আর লঞ্চ
প্রায় প্রতি মুহূর্তে বন্দরে ঢুকছে কিংবা বন্দর ত্যাগ করছে। একের পর এক বোট, জাহাজ, ফ্রেইটার।–
ট্রাক থামলি বোরিস। কোনদিকে যাবে এবার? কোথাও দেখা যাচ্ছে না সবুজ, ভ্যানটা। হাজারো জলযানের যে-কোনটাতে থাকতে পারে মুসা আর কিশোর। কোটাতে নিয়ে গিয়ে তোলা হয়েছে ওদেরকে, কি করে বোঝা যাবে?
রবিন, কিছু ভাবতে পারছি না আমি! তিক্ত কণ্ঠে বলল বোরিস। আর কোন আশা নেই!
কি জানি! কপালে আঙুল ঘষছে রবিন। রেডিওতে বলল-হঠাৎ এমনভাবে লাফিয়ে উঠল সে, যেন বোলতা হুল ফুটিয়েছে। চাঁদিতে কেবিনের ছাতের বাড়ি লাগতেই ধুপ করে বসে পড়ল আবার। চেঁচিয়ে উঠল, রেডিও! হ্যাঁ, রেডিও! বন্দরে ঢুকে আবার কথা বলবে বলেছিল! পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিয়েছে সে।
বেশি তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে কয়েক সেকেণ্ড দেরি করে ফেলল রবিন। পকেটের এখানে-ওখানে বেধে গেল ওয়াকি-টকি, কিন্তু হাতে বেরিয়ে এল অবশেষে।
বোতাম টিপে ওয়াকি-টকি অন করে দিল রবিন, কানের কাছে নিয়ে এল যন্ত্রটা। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে লাগল সে। কথা বলবে তো? নাকি এতক্ষণে বলে ফেলেছে? ন_
রবিনকে চমকে দিয়ে হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠল স্পীকার: অপারেশন থিয়েটার! বোট নামিয়ে দিয়েছি। সাঁইত্রিশ নাম্বারে থাক, পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তুলে নেব। মালপত্রসহ যাত্রীদেরকে তৈরি রাখ। সঙ্গে সঙ্গেই যাতে বেটে তুলে নেয়া যায়।
অপারেশন থিয়েটার বলছি, বার্টের গলা শোনা গেল স্পীকারে। বোটটা দেখতে পাচ্ছি। যাত্রী আর মালপত্র ট্রাকে তৈরিই আছে। তুলতে দেরি হবে না।
গুড। আমরা আরও কাছে এলে একটা সাদা রুমাল নাড়বে, তাহলে বুঝব কোন গোলমাল নেই। ওভার অ্যাণ্ড আউট।
চুপ হয়ে গেল স্পীকার। রবিন চেঁচিয়ে উঠল, বোরিস, জলদি, সাঁইত্রিশ নাম্বার জেটি! মাত্র পাঁচ মিনিট সময় আছে হাতে!
কিন্তু সাঁইত্রিশ নাম্বার কোন্টা? স্যান পেড্রোতে আসিনি আগে কখনও, এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে বোরিস।
কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে। জলদি!
ধীরে এগোল ট্রাক। একটা লোকও চোখে পড়ছে না। রোববারের এই সকালে নির্জন হয়ে আছে এলাকাটা, মৃত বন্দর যেন। সামনে একটা বাঁক। মোড় নিয়েই পুলিশের গাড়িটা দেখতে পেল ওরা।
ওই গাড়িটার পাশে, জলদি! আঙুল তুলে দেখাল রবিন।
জোরে ছুটে এসে পুলিশের গাড়ির পাশে ঘঁাচ করে ব্রেক কষল বোরিস।
জানালা দিয়ে মুখ বের করে চেঁচিয়ে বলল রবিন, এই যে, স্যার, সাঁইত্রিশ নাম্বার জেটিটা কোথায়, বলবেন?