কারুকাজ করা সুদৃশ্য কাঠের ফ্রেমে বাঁধাই দামি দামি ছবি ঝুলছে দেয়ালে। ওগুলো মিউজিয়মের সম্পত্তি। ছবির প্রতি তেমন আকর্ষণ দেখাল না তিন গোয়েন্দা, তারা এসেছে রত্ন আর অলঙ্কার দেখতে।
ছবিগুলোর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল কিশোর। ছবিগুলো কিভাবে ঝোলানো হয়েছে, লক্ষ্য করেছ? দেয়ালের ওপরের দিকের খাজ থেকে আটকানর ব্যবস্থা করা হয়েছে। আগে কিন্তু এভাবে ছবি ঝোলানো হত না। সিলিঙে হুক লাগিয়ে লম্বা শেকল দিয়ে ঝোলানো হত। দেখেছ, হুকগুলো এখনও আছে?
একবার ওপরে তাকিয়ে দেখল মুসা, কিন্তু গুরুত্ব দিল না। প্রায় দরজা আকারের বড় বড় জানালাগুলোর দিকে তার মন। জানালা বন্ধ করে দিল কেন ওরা?
দেয়ালে বেশি করে জায়গা করেছে, আরও বেশি ছবি ঝোলানর জন্যে, বলল। কিশোর। এটা একটা কারণ। তবে আসল কারণ বোধহয় ভাল এয়ারকণ্ডিশনিঙের জন্যে। দামি দামি ছবি, তাপমাত্রার পরিবর্তনে ক্ষতি হতে পারে, তাই সব সময় একই রকম উত্তাপ রাখার জন্যে এই ব্যবস্থা হয়েছে।
ধীরে ধীরে পুরো ঘরে চক্কর দিল ওরা, তারপর ভিড়ের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির পেছন। দিকের আরেকটা বড় হলঘরে এসে ঢুকল। তারপর চলে এল বাঁ-শাখার গম্বুজওয়ালা ঘরটায়। এখানেই রত্ন প্রদর্শনীর ব্যবস্থা হয়েছে। ডান শাখার ঘরটার মত এখানেও দেয়ালের মাঝামাঝি ব্যালকনি রয়েছে। ব্যালকনিতে ওঠার সিঁড়ির। মাথা দড়ি আটকে রুদ্ধ করা হয়েছে।
ঘরের ঠিক কেন্দ্রে রয়েছে রেইনবো জুয়েলস। কাঁচের বাক্সটা ঘিরে রয়েছে। খুঁটি, ওগুলোতে বেঁধে রঙিন মখমলের দড়ির ঘের দেয়া হয়েছে। ঘেরের এপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে বাক্সটার নাগাল পাওয়া যায় না।
সুন্দর ব্যবস্থা, সারির মধ্যে থেকে চলতে চলতে বলল কিশোর। হঠাৎ গিয়ে। ঘুসি মেরে বাক্স ভেঙে হারটা তুলে নিতে পারবে না চোর।
এক জায়গায় চুপচাপ দাঁড়িয়ে কিছু দেখার উপায় নেই, এত ভিড়। সারি চলছে ধীরে ধীরে, তারই মাঝে থেকে চলতে চলতে যতখানি দেখে নেয়া যায়। বড় একটা হীরা-নীল আলো ছড়াচ্ছে, মস্ত জোনাকির মত জ্বলে আছে একটা পান্না, জলন্ত কয়লার মত ধক ধক করছে একটা চুনি, আর জ্বলজ্বলে সাদা বিশাল একটা মুক্তা-এই চারটে পাথরই বেশ কায়দা করে বসানো হয়েছে রত্নহারটাতে। ওগুলোকে ঘিরে ঝকমক করছে ছোটবড় আরও অসংখ্য পাথর৷ ঠিক নামই রাখা। হয়েছে, রামধনু রত্নহার, রামধনুর মতই সাতরঙ বিচ্ছুরিত হচ্ছে পাথরগুলো থেকে।
কাঁচের বাক্সের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে আছে একজন গার্ড। তাকে জিজ্ঞেস করে জানা গেল হারটার দাম বিশ লক্ষ আমেরিকান ডলার। দাম শুনে হু-ই-ই-ই করে। উঠল এক গার্ল স্কাউট।
এক দিকের দেয়ালের কাছে চলে এল তিন গোয়েন্দা। ব্যালকনির ঠিক নিচেই আরেকটা কাঁচের বাক্সে রাখা হয়েছে ফুট তিনেক লম্বা সোনার বেল্টটা। অনেকগুলো। চারকোনা সোনার টুকরো গেঁথে তৈরি হয়েছে বেল্ট। প্রতিটি টুকরোর মাঝখানে বসানো একটা করে চৌকোনা পান্না, ধারগুলোতে বসানো হয়েছে মুক্তা। দুই মাথার বকলেসে রয়েছে হীরা এবং চুনি। বেল্টের আকার দেখেই বোঝা যায়, এটা যিনি পরতেন, বিশালদেহী মানুষ ছিলেন তিনি।
সম্রাটের সোনার বেল্ট এটার নাম, বেল্টের বাক্সের কাছে দাঁড়ানো এক গার্ড বলল। জিনিসটা প্রায় হাজার বছরের পুরানো। ওজন পনেরো পাউণ্ডের মত। খুবই দামি জিনিস, কিন্তু আসল দাম কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে এর ঐতিহাসিক মূল্য।
আরও কিছুক্ষণ বেল্টটা দেখার ইচ্ছে ছিল তিন গোয়েন্দার, কিন্তু পেছনের চাপে বাধ্য হয়ে সরে আসতে হল। অসংখ্য কাঁচের বাক্সে সাজিয়ে রাখা হয়েছে আরও অনেক মূল্যবান জিনিস, তার প্রায় সবই সুকিমিচি জুয়েলারস-এর তৈরি। আঠা দিয়ে মুক্তা আর কাঁচ জুড়ে তৈরি হয়েছে হাঁস, ঘুঘুপাখি, মাছ, হরিণ আর অন্যান্য অনেক জীবজন্তুর প্রতিকৃতি। ছেলেরা চুপচাপ মুগ্ধ চোখে দেখছে, কিন্তু মেয়েরা চুপ করে থাকতে পারছে না। চারদিক থেকে কেবল তাদের হুইই-হাইই, ইস-আস্স্ শোনা যাচ্ছে।
প্রায় ভরে গেছে এখন ঘরটা। কথা বলার জন্যে খালি একটু জায়গা দেখে সরে এল তিন গোয়েন্দা।
কত গার্ড দেখেছ? বলল কিশোর। দিনের বেলা এখানে চুরি করা সম্ভব নয়। করলে রাতে করতে হবে। কিন্তু কিভাবে? ঢুকবে কি করে? অ্যালার্ম ফাঁকি দিয়ে বাক্স ভাঙবে কি করে? মাথা নাড়ল সে আপনমনেই। আমার মনে হয় না চুরি করতে পারবে, যদি না—
হুপপ! কিশোরের গায়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল লোকটা। হাতঘড়ির দিকে চেয়ে পিছিয়ে এসেছে, আর কোনদিকেই নজর ছিল না।
আরে, মিস্টার মার্চ? বলে উঠল কিশোর।
কে! ভুরু কুঁচকে তাকাল লোকটা।
আরে, আমাকে চিনতে পারছেন না? আমি কিশোর, কিশোর পাশা। টেলিভিশনে কমিকে অভিনয় করতাম, মনে নেই? আমরা বাচ্চারা যত গণ্ডগোল বাধ্যতাম, আপনি তার খেসারত দিতেন, মনে পড়ছে?
কি, কিশোর পাশা! ও ইয়ে..হা হা! চেঁচিয়ে উঠল লোকটা। কিন্তু এখন তো কথা বলার সময় নেই আমার, অভিনয় করতে হবে।
অভিনয়?
দেখ, কি করি, হাসল মিস্টার মার্চ। মজা দেখ। ওই যে, একটা গার্ড। গলা। চড়িয়ে ডাকল, গার্ড! গার্ড!
ঘুরল ইউনিফর্ম পরা গার্ড। থমথমে চেহারা। কি হয়েছে? ভারি কণ্ঠ।
টলে উঠল মার্চ। আমার-আমার মাথা ঘুরছে!…পানি! পানি! পকেট থেকে রুমাল বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে কপালের ঘাম মুছল সে। হাত কাঁপছে বলেই বোধহয়, রুমালের ভাঁজ থেকে খুট করে কিছু একটা মেঝেতে পড়ে গেল। লাল একটা পাথর, রুবির মত দেখতে। আহহা! চেহারায় শঙ্কা ফুটল অভিনেতার।