কাছেই কথা বলছে কেউ। উঠে বসে ফিরে চেয়ে দেখল মুসা, কিশোরের হাতে। এক কাপ সুপ। তার পাশে একটা বাক্সের ওপর বসে আছে বার্ট। কিশোরের চেহারায় কেমন একটা খুশি খুশি ভাব।
মাটি কোপানর শব্দ শোনা যাচ্ছে না আর, বোধহয় সুড়ঙ্গ খোঁড়া শেষ হয়ে গেছে। ঘরের কোণে বসে স্যাণ্ডউইচ খাচ্ছে রত্নদানোরা। রিক আর জিমকে দেখা। যাচ্ছে না। সুড়ঙ্গের দিকে তাকাতেই মোটা বৈদ্যুতিক তারটা চোখে পড়ল মুসার, সাপের মত একেবেঁকে ঢুকে গেছে সুড়ঙ্গের ভেতরে। মোটরের আবছা গুঞ্জন কানে। আসছে। ও, বোঝা গেছে, মেশিন দিয়ে ভল্টের কংক্রিটের দেয়ালে ছিদ্র করছে জিম। আর রিক।
গুড মর্নিং, মুসা, হেসে বলল কিশোর। ঘুম ভাল হয়েছে তো?
হা হা, নিশ্চয়, স্বপ্নে এক রাজকুমারীকে বিয়েও করে ফেলেছি। ব্যঙ্গ ঝরল মুসার কথায়। এই বিপদের সময়ে কিশোরের হাসি আসছে কিভাবে বুঝতে পারছে না সে। কিশোরের কাপের দিকে আবার চোখ পড়তেই স্বর নরম করে ফেলল, কিশোর, আর কাপ নেই? মানে, সুপ দেয়া হবে না আমাকে?
মুসার কথার ধনে হো হো করে হেসে উঠল বার্ট। মুসাকেও এক কাপ সুপ দিল। বিচ্ছু ছেলে! তবে এখানে আর ইবলিসগিরি করতে পারবে না, ভালমত আটকেছি।
তোমরাও কম ইবলিস নাকি? যেন ঘরোয়া আলাপ-সালাপ করছে কিশোর, এমনি ভাব। প্রথমে তো পুরো বোকা বানিয়ে দিয়েছিলে আমাদেরকে। আঙিনায় তোমার পাঠানো দানাগুলোকে দেখে প্রথমে ভেবেছিলাম, ওটা ববের কাজ। ফুফুকে ভয় পাইয়ে বাড়ি থেকে তাড়ানর জন্যে ওই ফন্দি করেছে। তারপরে, ওরা যখন থিয়েটারের ভেতরে এসে ঢুকল, তখন বুঝলাম আসল ঘটনাটা।
আরেকটু হলেই দিয়েছিলে আমাদের বারোটা বাজিয়ে, দুআঙুলে চুটকি বাজাল বার্ট। পুলিশ তো প্রায় নিয়েই এসেছিলে, মুসার দিকে ফিরে বলল, চেহারা হাবাগোবার মত করে রাখলে কি হবে, ভীষণ চালাক তোমার বন্ধু। তবে এই অভিনয়টা খুব কাজে লাগবে। লোকে সন্দেহই করতে পারবে না। ওকে আমি ভালমত ট্রেনিং দিয়ে দেব। দশ বছরেই দুনিয়ার সেরা ক্রিমিন্যাল হয়ে উঠবে ও।
ধন্যবাদ, ক্রিমিন্যাল হতে চাই না আমি, মোলায়েম গলায় বলল কিশোর। ক্রিমিন্যালদের পরিণতি খুব খারাপ হয়।
বলে কি ছেলে! আরে, খোকা, তুমি জান, কার সঙ্গে কথা বলছ? দেশের সবচেয়ে ঝানু ক্রিমিনালদের একজনের সঙ্গে। মাথায় ঘিলু থাকলে সারা জীবন। অপরাধ করে বেড়াতে হয় না। প্রচুর পরিশ্রম করে বুদ্ধি খাঁটিয়ে ভালমত একটা দান মেরে দিতে পারলেই বাকি জীবন বসে খাওয়ার ব্যবস্থা হয়ে যায়। ঠিক আছে, তোমার ইচ্ছে। আমার সঙ্গে থাকতে না চাইলে কি আর করব? খারাপ কাজটাই করতে হবে আমাকে।
বার্টের কথার মানে বুঝতে পারল না মুসা, কিন্তু কেন যেন শিরশির করে উঠল তার মেরুদণ্ডের ভেতরটা।
অনেক কথা জানার আছে মুসার, তাড়াতাড়ি বলে উঠল কিশোর। মিস্টার বার্ট, এই ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা কি করে করলেন, খুলেই বলুন না সব ওকে।
নিশ্চয়, নিশ্চয়, সুপের জগ তুলল বার্ট। আরেক কাপ নেবে?
আমার আর লাগবে না। মুসাকে দিন।
মুসার কাপ ভরতি করে সুপ ঢেলে দিল বার্ট। হ্যাঁ, গোড়া থেকেই বলি, জগ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল সে। এই ব্লকের পাশের ব্লকটাতেই আমার বাড়ি। বছর চল্লিশেক আগে মিস ভারনিয়ার এক রত্নদানে ছিলাম আমিও। দাঁত বের করে। হাসল বাট। আমাকে দানো কল্পনা করতে কেমন লাগছে? প্রশ্নের জবাবের। অপেক্ষা না করেই বলল, হপ্তায় একবার করে পাড়ার যত ছেলেমেয়েকে নিয়ে পার্টি দিত মিস ভারনিয়া। আইসক্রীম খাওয়াত, কেক খাওয়াত, তারপর তার বই থেকে গল্প পড়ে শোনাত।
বার্টের কাছে জানা গেল, তার বাবা ছিল রাজমিস্ত্রী, এই মূরিশ থিয়েটার আর পাশের ব্যাংকটা বানাবার সময় এখানে কাজ করেছিল। বাবার কাছেই ব্যাংকের ভল্টের কথা শুনেছে বার্ট। ওটার দরজা ইস্পাতের, কিন্তু দেয়াল তৈরি হয়েছে কংক্রিট দিয়ে। মাটির অনেক গভীরে তৈরি হয়েছে ভল্ট, তাই ইস্পাতের দেয়াল দেয়ার কথা ভাবেনি ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। এই সুযোগটাই নিয়েছে বার্ট।
ওরা ভাবেনি, কিন্তু আমি ভেবেছি, বলল বার্ট। ইচ্ছে করলেই ওই ভল্ট থেকে টাকা লুট করা যায়। মিস ভারনিয়ার ভাড়ার থেকে সুড়ঙ্গ খোঁড়া শুরু করলে মাটির তলা দিয়েই পৌঁছে যাওয়া যায় ভল্টের কাছে। তারপর কংক্রিটের দেয়াল ভেঙে ফেলাটা কোন কাজই না।
তখন এই এলাকায় ভাঙচুর শুরু হয়েছে। বসতবাড়ি বিক্রি করে দিয়ে চলে যাচ্ছে লোকে। আমি ভাবলাম, মিস ভারনিয়াও চলে যাবে, কিন্তু গেল না সে। অপেক্ষা করে করে বিরক্ত হয়ে উঠলাম। এই সময়েই একদিন শুনলাম, থিয়েটার বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মালিকানা হাত বদল হয়ে গেছে। নতুন আইডিয়া এল মাথায়। থিয়েটার-হাউসের নিচতলার কোন একটা ঘর থেকে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে মিস। ভারনিয়ার বাড়ির নিচ দিয়ে পৌঁছে যাওয়া যায় ব্যাংকের ভল্টে। তখুনি কাজে লেগে যেতাম, কিন্তু একটা অপরাধের জন্যে ধরা পড়লাম পুলিশের হাতে, কয়েক বছর জেল হয়ে গেল।
জেলে বসে একের পর এক প্ল্যান করেছি। জেল থেকে ছাড়া পেয়েই কাজে নেমে পড়লাম। খুঁজে খুঁজে লোক জোগাড় করে একটা দল গড়লাম। থিয়েটার হাউসে তখন দুজন নাইটগার্ড। রাতে বিচিত্র শব্দ করে ভয় দেখিয়ে ওদেরকে তাড়ালাম। নতুন নাইটগার্ড দরকার মিস্টার রবার্টের। তার কাছে গিয়ে চাকরি চাইতেই চাকরি হয়ে গেল।