এই যে আসছি, আসছি!
নামার চেয়ে ওঠা অনেক বেশি কঠিন। অনেক কষ্টে মিনারেটের কাছাকাছি উঠে এল মুসা। তাকে ধরে তুলে নিল দুটো বলিষ্ঠ হাত।
বার্ট ছাড়াও আরও দুজন রয়েছে মিনারেটে, কিশোরকে চেপে ধরে রেখেছে। দুদিক থেকে।
মুসার পিঠে কনুই দিয়ে গুতো মারল বার্ট। আগে বাড়।
অনেক সিঁড়ি, অনেক মোড়, গলিঘুজি আর করিডর পার করে নিচের তলার একটা ঘরে নিয়ে আসা হল দুই গোয়েন্দাকে। কংক্রিটের এবড়োখেবড়ো দেয়াল, একপাশে বড় বড় দুটো মরচে-পড়া বয়লার পড়ে আছে। থিয়েটারের হল রুম গরম রাখার কাজে ব্যবহৃত হত নিশ্চয় ওগুলো, ভাবল মুসা।
একপাশের দেয়ালে কয়েকটা বন্ধ দরজা। প্রথম দরজাটার গায়ে লেখা: কোল বিন নং ১, তারপরে কোল বিন নং ২, এবং কোল বিন নং ৩। রঙ চটে গেছে, কোনমতে পড়া যায় শব্দগুলো। মুসা বুঝল, ওগুলো কয়লা রাখার ঘর।
এক নাম্বার ঘরের দরজা খুলে ছেলেদেরকে ভেতরে ঠেলে দিল বার্ট।
বিস্ময়ে ঘোঁৎ করে উঠল মুসা। এক কোণে বসে তাস খেলছে সেই চার রত্নদানো। একবার চোখ তুলে চেয়েই আবার খেলায় মন দিল ওরা। অনেকগুলো কোদাল, গাঁইতি আর শাবল ফেলে রাখা হয়েছে এক ধারে মেঝেতে কয়েকটা বড় বৈদ্যুতিক লণ্ঠনও আছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি অবাক হল মুসা কংক্রিটের দেয়ালে। একটা কালো ফোকর দেখে। নিশ্চয় মাটির নিচে রয়েছে দেয়ালের ওই অংশ, কারণ ফোকরটার ওপাশে কালো সুড়ঙ্গমত দেখা যাচ্ছে।
দ্রুত চিন্তা চলেছে মুসার মাথায়। তার মনে হল, সুড়ঙ্গটা গেছে মিস ভারনিয়ার। বাড়ির দিকে। নাকি বাড়ির তলা দিয়ে অন্য কোথাও চলে গেছে? চকিতে বুঝে গেল কিশোরের কথার মানে, গুপ্তধনের সন্ধানে সুড়ঙ্গ খুঁড়ছে—ব্যাংক–হ্যাঁ, ব্যাংকে গুপ্ত রইয়েছে এই ধন!
কয়েকজন লোক আর ওই চারটে অদ্ভুত জীব আসলে ডাকাত। ব্যাংক ডাকাতির পরিকল্পনা করেছে ওরা!
.
১৩.
কংক্রিটের দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে একগাদা বস্তার ওপর বসেছে মুসা আর কিশোর। দুজনেরই হাত-পা বাঁধা। মুখ খোলা, ইচ্ছে করলে কথা বলতে পারে, কিন্তু কথা বলার প্রবৃত্তি হচ্ছে না কিশোরের।
ডাকাতদের কাজকর্ম দেখছে মুসা। বার্টকেই নেতা বলে মনে হচ্ছে, অন্য দুজন, জিম আর রিক তার সহকারী। বেঁটে বলিষ্ঠদেহী লোকটার নাম জিম। রিকের ইয়া বড় গোঁফ, রোগাটে শরীর, কথা বললেই লণ্ঠনের আলোয় ঝিক করে উঠছে ওপরের পাটির একটা সোনায় বাধানো দাঁত।
কিশোর, ফিসফিস করে বলল মুসা। বার্ট ব্যাংক ডাকাত, না? মিস্টার রবার্টের নাইটগার্ডের কাজ নিয়েছে সে ইচ্ছে করেই, ডাকাতি করার জন্যে।
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছ, নিচু গলায় বলল কিশোর। শুরুতেই ব্যাপারটা বোঝা। উচিত ছিল আমার। দুটো গুরুত্বপূর্ণ সূত্রও ছিল। গাঁইতি দিয়ে মাটি কোপানর শব্দ আর কাছেই একটা ব্যাংক। অথচ কি করলাম? গাধার মত রত্নদানোর দিকে নজর দিয়ে বসলাম।
তোমার কি দোষ? সান্তনা দিল মুসা। স্বয়ং শার্লক হোমসও আগে থেকে ব্যাপারটা বুঝতে পারত না। চমৎকার বুদ্ধি করেছে ব্যাটারা! রহদানোর দিকে নজর ফিরিয়ে রেখেছে আমাদের, বুঝতেই দেয়নি আসল কথা। আচ্ছা, কিশোর, একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না, দানো ব্যাটারা তাস খেলছে, ওদিকে তিন ডাকাত কাজ করতে করতে ঘেমে উঠেছে।
সুড়ঙ্গ খোঁড়ার জন্যে ডাকা হয়নি ওদেরকে, ক্ষোভ প্রকাশ পেল কিশোরের কথায়। ওদেরকে ভাড়া করা হয়েছে মিস ভারনিয়াকে ভয় দেখানর জন্যে, যেন তার কথা লোকে বিশ্বাস না করে সেজন্যে।
অ-অ, বুঝেছি। কিন্তু রত্নদানোদের খোঁজ পেল কি করে বার্ট, আনল কোত্থেকে? ব্ল্যাক ফরেস্ট থেকে?
হায়রে কপাল! হতাশ ভঙ্গিতে এদিক-ওদিক মাথা নাড়ল কিশোর। ব্ল্যাক ফরেস্ট থেকে আমদানি করতে যাবে কেন? ওদেরকে আনা হয়েছে রূপকথার পাতা থেকে। আঙিনায় ব্যাটাদেরকে নাচতে দেখেই সেটা অনুমান করেছিলাম।
কিশোরের কথা আরও দুর্বোধ্য লাগল মুসার কাছে, কিন্তু বকা শোনার ভয়ে আর প্রশ্ন করল না, চুপ করে ভাবতে লাগল। মিস ভারনিয়ার লেখা বইয়ের পাতা থেকে? কি মানে এর?
ডাকাতদের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। সুড়ঙ্গের শেষ মাথা কাটা চলছে এখন। আলগা মাটি ঝুড়িতে করে ফেলে দিয়ে যাচ্ছে সুড়ঙ্গমুখের বাইরে।
আর মাত্র ফুট দশেক, রিক, জিমকে বলতে শুনল মুসা।
ওই দশ ফুটেই তো জান বের করে ছাড়বে! বলল রিক।
মাটি ফেলতে এসেছিল, ঝুড়ি নিয়ে আবার ভেতরে ঢুকে গেল দুজনে।
আরেকটা প্রশ্ন জাগল মুসার মনে। কিশোর-.. বলতে বলতেই থেমে গেল সে। বস্তার ওপর লম্বা হয়ে শুয়ে পড়েছে গোয়েন্দাপ্রধান। ঘুমিয়ে পড়েছে।
দেখ কাণ্ড কিশোরের!অবাক হয়ে ভাবল মুসা। কোথায় মগজ খাঁটিয়ে এই বিপদ থেকে উদ্ধার পাওয়ার চেষ্টা করবে, তা না, ঘুমিয়ে পড়েছে। তারপরই মনে হল মুসার, সামনে রাতের অনেকখানি পড়ে আছে। পালানর চেষ্টা করতে হলে শক্তি সঞ্চয় করা দরকার তাদের। যেইমাত্র সুড়ঙ্গ খোঁড়া শেষ হবে, ব্যাংকের ভল্ট থেকে। টাকা নিয়ে পালাবে ডাকাতেরা। ততক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে পারলে মন্দ কি? ঠিক কাজই। করেছে কিশোর।
মুসাও শুয়ে পড়ল। মন থেকে দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলতেই ঘুম এসে গেল তার চোখেও।
কতক্ষণ ঘুমিয়েছে, বলতে পারবে না মুসা, কিন্তু এখন বেশ ঝরঝরে লাগছে শরীরটা। তবে হাত-পায়ের যেখানে যেখানে দড়ি বাধা, সেখানে টনটন করছে।