পড়ব মানে কি? পড়েই তো আছি। বরং বল, বিপদ আরও বাড়বে।
চল, অন্য জায়গা খুঁজি। এখানে লুকানো যাবে না।
প্রোজেকশন রুমের পাশে একটা হলে এসে ঢুকল ওরা। ঘরের এক প্রান্ত থেকে একটা সিঁড়ি উঠে গেছে ছোট একটা প্ল্যাটফরমে, ওটাতে উঠে এল দুজনে। সামনে একটা দরজার গায়ে লেখা।
মিনারেট
প্রবেশ নিষেধ।
মিনারেট! কোনরকম দানব-টানব? মুসা অবাক।
তুমি বোধহয় মাইনোটারের কথা ভাবছ? গ্রীক মিথোলজির ষড়মাথা দানব, কিশোর বলল। এটা মাইনোটার নয়, মিনারেট, টাওয়ারের ওপরের খোলা জায়গা। চল, ওখানেই উঠে পড়ি। একটা বুদ্ধি এসেছে, দরজায় ঠেলা দিল কিশোর।
লোহার পাল্লা, মরচে পড়ে শক্ত হয়ে আটকে আছে। দুজনে মিলে জোরে ধাক্কা দিতেই শব্দ করে খুলে গেল। খুব সরু একটা লোহার মই উঠে গেছে দরজার ওপাশ থেকে। মই বেয়ে উঠতে শুরু করল ওরা।
মিনিটখানেক পরে টাওয়ারের চারকোনা একটা খোলা জায়গায় এসে উঠল। ওরা। অনেক নিচে রাস্তা, নির্জন, শুধু পথের ধারের লাইটপোস্টগুলো প্রহরীর মত দাঁড়িয়ে আছে।
মিনারেটে তো উঠলাম, বলল মুসা, এবার? এখান থেকে আর কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। আরও ভালমত আটকা পড়লাম।
আটকা আর পড়লাম কোথায়? পথের দিকে চেয়ে আছে কিশোর। নিচেই রাস্তা, ওখানে কোনমতে নেমে যেতে পারলেই হল। মাত্র পঁচাত্তর ফুট।
মাত্র পঁচাত্তর ফুট! লাফিয়ে নামব নাকি?
কেন, সঙ্গে দড়ি আছে না? দড়ির বাণ্ডিল খুলে নিল কিশোর। পাকিয়ে মোটা করে নিয়েছিলাম। পাক খুললেই অনেক লম্বা হয়ে যাবে। হলেও তোমার ডবল ওজন সইতে পারবে।
আমার? আমার কেন? তোমার নয় কেন?
কারণ, তোমার মত ভাল অ্যাথলেট নই আমি, শান্তকণ্ঠে বলল কিশোর। আমি চেষ্টা করলে বড় জোর পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙতে পারি, এর বেশি কিছু। করতে পারব না, কিন্তু তুমি নিরাপদে নেমে যেতে পারবে। ওই যে, অনেক শিক বেরিয়ে আছে। ওগুলোর কোনটায় দড়ি বেঁধে দিচ্ছি, নেমে গিয়ে পুলিশ ডেকে নিয়ে। এস। মিস ভারনিয়ার জন্যে অপেক্ষা করলে চলবে না।
দ্রুত দড়ির পাক খুলে ফেলল কিশোর।
টেনেটুনে দড়িটা দেখল মুসা। বেশি সরু, পিচ্ছিল। ধরে রাখাই মুশকিল। হবে। হাতে কেটে বসে যাবে।
যাবে না। দস্তানার তালুতে চামড়া রয়েছে, সহজে কাটবে না। হাতের কব্জিতে এক পাক দিয়ে ঝুলে পড়কে দড়ি ধরে, তারপর আস্তে আস্তে ছাড়লেই সরসর করে। নেমে যেতে পারবে।
হাতে দড়ি পেঁচিয়ে টেনেটুনে দেখল মুসা। মাথা ঝাঁকাল। হ্যাঁ, পারব মনে হচ্ছে। কিন্তু একটা কথার জবাব দেবে?
কি? শিকে দড়ি বাধছে কিশোর।
রত্নদানো আমরা সত্যি দেখলাম তাহলে?
খুদে মানুষ দেখলাম, মুখ তুলল কিশোর। আমি একটা আস্ত গাধা! আমার ধারণা ছিল, মিস ভারনিয়াকে ভয় দেখিয়ে তাড়ানর চেষ্টা করছে ওরা, যাতে উনি বাড়ি বিক্রি করে দেন। বুঝতেই পারিনি সত্যি সত্যি গুপ্তধনের জন্যে মাটি খুঁড়ছে। ওরা।
গাধা! অযথা গালমন্দ করছ নিজেকে। তুমি কেন, কেউই বুঝতে পারত না। তখন, মিস ভারনিয়ার বাড়ির তলায় গুপ্তধন খুঁজছে দানোরা।
মিস ভারনিয়ার বাড়ির তলায় নয়, মুসা এখনও বুঝতে পারছে না দেখে বিরক্ত হল কিশোর। এখান থেকে সবচেয়ে কাছের গুপ্তধন কোথায়?
হবে হয়ত, পাহাড়ের তলায় কোথাও!
তোমার মাথা! কেন, ব্যাংকটা চোখে পড়ে না?
ব্যাংক? বোকা হয়ে গেছে যেন মুসা। মানে?
হাল ছেড়ে দিল কিশোর, এত কথা বলার সময় নেই এখন। যাও, নাম। যে কোন সময় ব্যাটারা এসে পড়তে পারে। সাবধান, বেশি তাড়াহুড়ো কোরো না।
কিশোর যেভাবে বলেছে ঠিক সেভাবে নামা সম্ভব হল না, দড়ি ধরে ঝুলে বাঁকা হয়ে দেয়ালে পা ঠেকিয়ে নামতে লাগল মুসা। নিচের দিকে তাকাল না একবারও।
অর্ধেকটা মত নেমেছে মুসা, এই সময় ওপরে চিৎকার শুনল। একবার গুঙিয়ে উঠল কিশোর, তারপরেই চুপ হয়ে গেল। ধড়াস করে এক লাফ মারল মুসার হৃৎপিণ্ড। কিশোরকে কি ধরে ফেলেছে:-প্রচণ্ড জোরে দড়িতে নাড়া লাগল, আরেকটু হলে হাতই ছুটে গিয়েছিল মুসার। শক্ত করে দড়ি আঁকড়ে ধরল সে।
এই যে, বিচ্ছু! শোনা গেল বার্টের কর্কশ গলা। নিচে নামছ। হ্যাঁ, তোমাকে বলছি।
ঢোক গিলল মুসা। আবার নাড়া লাগল দড়িতে। প্রাণপণে দড়ি ধরে রইল সে। ব-বল!
উঠে এস।
নিচে নামছি তো! নিজের কানেই বেখাপ্পা শোনাল মুসার কথা।
হঠাৎ নেমে যাবে কিন্তু! ধমকে উঠল বার্ট। দড়ি কেটে দেব।
নিচে তাকাল মুসা। আর বড় জোর তিরিশ ফুট বাকি, ঘাস থাকলে লাফিয়ে পড়তে পারত। কিন্তু কংক্রিটে বাঁধানো কঠিন পথ, দুই পায়ের হাড় কয়েক টুকরো হয়ে যাবে এখান থেকে লাফ দিলে।
কি হল, বিচ্ছু? নড়ছ না কেন? তিন পর্যন্ত গুনব, তারপর দেব দড়ি কেটে!
দাঁড়াও দাঁড়াও, গোনার দরকার নেই! চেঁচিয়ে বলল মুসা। আমি উঠে আসছি। দড়ি পিছলে যেতে চায়, শক্ত করে ধরে নিই।
ঠিক আছে। কিন্তু কোনরকম চালাকি চাই না।
একটা বুদ্ধি এসেছে মুসার মাথায়। তেমন কিছুই নয়, তবে এতে কাজ হলেও হতে পারে। ডান হাতে দড়ি ধরে ঝুলে থেকে দাঁতে কামড়ে ডান হাতের দস্তানা খুলে ফেলল। পকেট হাতড়ে নীল চক, বের করে ময়লা দেয়ালে বড়সড় একটা প্রশ্নবোধক চিহ্ন আঁকল। নিচে ফেলে দিল বাকি চকটা।
আরে অই, বিচ্ছ! অধৈর্য হয়ে পড়েছে বার্ট। উঠছ না কেন? দেব নাকি দড়ি কেটে?