টর্চ হাতে একপাশের করিডর ধরে ছুটল মুসা। এক সারি সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। এক মুহূর্ত দ্বিধা করেই পা রাখল সিঁড়িতে।
একেকবারে দুতিনটে করে সিঁড়ি টপকাতে লাগল দুজনে। ঘুরে ঘুরে উঠে গেছে পুরানো ধাচের সিঁড়ি, শেষ নেই যেন এর। কয়টা মোড় ঘুরল ওরা, বলতে। পারবে না।
সিঁড়ি শেষ হল। ব্যালকনিতে উঠে এল ওরা। জিরিয়ে নেয়ার জন্যে থামল। একধারে ঘোরানো রেলিঙ, রঙিন মখমলে ঢাকা। টর্চ নিভিয়ে সেদিকে এগোল মুসা।
রেলিঙের ওপর দিয়ে সাবধানে উঁকি দিল দুই গোয়েন্দা। অনেক নিচে হলের। মেঝেতে চারটে খুদে মূর্তি এক জায়গায় জড়ো হয়ে উত্তেজিতভাবে কথা বলছে। এক সময় আরেকটা মূর্তি এসে যোগ দিল ওদের সঙ্গে। বলিষ্ঠদেহী স্বাভাবিক একজন মানুষ।
বার্ট! আঁতকে উঠল মুসা, চাপা কষ্ঠস্বর। দানোদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে বার্ট!
তাই তো দেখছি! ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেছে কিশোর। মস্ত একটা ভুল করেছি আমি, মুসা।…ওই যে, শোন।
দাঁড়িয়ে আছ কেন, চামচিকের দল! নিচে ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছে বার্ট। খোঁজ, খোঁজ! বিছুদুটেন্তকধরতেই হবে! সব দরজা আটকানো, পালাতে পারবে না ওরা।
ছড়িয়ে পড়ল চারটে খুদে মানুষ।
আমরা কোথায়, বুঝতে পারছে না ব্যাটারা, ফিসফিস করে বলল কিশোর। কোথাও লুকিয়ে থাকতে হবে আমাদের এখন। মিস ভারনিয়া জেগে উঠলেই আমাদের খোঁজ পড়বে—
ইয়াল্লা! ভুলেই গিয়েছিলাম! তাই তো, আমাদের না দেখলে পুলিশকে খবর পাঠাবেন তিনি! এ-বাড়িতে নিশ্চয় খুঁজবে পুলিশ, আশায় দুলে উঠল মুসার বুক।
ঝোঁপের ধারে আমার ক্যামেরাটা খুঁজে পাবে পুলিশ, কিশোর বলল। ফিল বের করে দেখলেই বুঝে যাবে, অদ্ভুত কিছু একটা ঘটছে এই এলাকায়।
চল, কোথাও লুকিয়ে পড়ি, অধৈর্য কণ্ঠে বলল মুসা। শুনতে পাচ্ছ না, সিঁড়িতে শব্দ?
.
১২.
পরিচিত একটা শব্দ শুনে ঘুম ভেঙে গেল মিস ভারনিয়ার: গাঁইতি দিয়ে মাটি কোপাচ্ছে কেউ! চুপচাপ বিছানায় পড়ে রইলেন কয়েক মুহূর্ত। হ্যাঁ, সেই শব্দ! তাঁর ঘরের ভিতের নিচে যেন মাটি কাটছে রত্নদানোরা!
ছেলেরা কি শুনতে পাচ্ছে? ওরা থাকায় ভালই হয়েছে, ভাবলেন মিস ভারনিয়া। কিন্তু কোনরকম সাড়াশব্দ নেই কেন ওদের? এখনও ঘুমিয়ে আছে।
কিশোর! মুসা! গলা চড়িয়ে ডাকলেন লেখিকা।
সাড়া এল না। উঠে গিয়ে ডেকে ওদের জাগাতে হবে, ভাবলেন মিস ভারনিয়া। বিছানা থেকে নেমে পায়ে স্লিপার গলালেন। একটা আলোয়ান গায়ে চড়িয়ে। বেরোলেন ঘর থেকে। ছেলেদের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ালেন।
কিশোর! মুসা! আবার ডাকলেন মিস ভারনিয়া।
কোন সাড়া নেই। অবাক কাণ্ড! দরজা খুলে সুইচ টিপে আলো জ্বেলে দিলেন তিনি। বিছানার দিকে চোখ পড়তেই দম আটকে গেল যেন। শূন্য বিছানা!
দুরুদুরু করতে লাগল বুকের ভেতর, সারা ঘরে চোখ বোলালেন মিস ভারনিয়া। চেয়ারের হেলানে রাখা আছে মুসার পায়জামা, ভাজও খোলা হয়নি। টেবিলে পড়ে আছে ছেলেদের ব্যাগ, অথচ ওরা নেই। এর মানে? পালায়নি তো! নিশ্চয় মাটি কাটার শব্দ শুনেছে, দানোদের দেখেছে, ব্যস ভয় পেয়ে পালিয়ে গেছে। মুসা আর কিশোর।
ঈশ্বর! আপনমনেই বিড়বিড় করলেন লেখিকা, এখন আমি কি করি!
আর থাকা যায় না এ-বাড়িতে, ভাবলেন মিস ভারনিয়া। মুসা আর কিশোরের মত ছেলেও যখন ভয় পেয়ে পালিয়েছে, তিনি আর থাকেন কোন ভরসায়? নাহ, আর থাকবেন না, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন লেখিকা।
আপাতত ববের ওখানে গিয়েই উঠবেন, ভেবে, তাকে টেলিফোন করার জন্যে নিচে নামলেন মিস ভারনিয়া। হাত কাঁপছে, ডায়াল করতে পারছেন না ঠিকমত। সঠিক নাম্বার পাওয়ার জন্যে তিনবার চেষ্টা করতে হল তাঁকে। অবশেষে রিসিভারে ভেসে এল ববের ঘুমজড়িত কণ্ঠ।
বব! ভয়ে ভয়ে এদিক-ওদিক তাকালেন মিস ভারনিয়া। রত্নদানো! আবার এসেছে! স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছি মাটি কোপানর শব্দ! বব, আর এক মুহূর্তও এখানে না! তোমার ওখানে চলে আসছি এখুনি। কাল..হ্যাঁ,কালই বাড়ি বিক্রি করে দেব!
বাড়ি বিক্রির কথা পরে হবে, ফুফু, ঘুমের লেশমাত্র নেই আর ববের কণ্ঠে। জলদি তৈরি হয়ে নাও। আমি আসছি, এই বড় জোর দশ মিনিট।
পাঁচ মিনিটেই হয়ে যাবে আমার, রিসিভার নামিয়ে রাখলেন মিস ভারনিয়া।
ববের গাড়িতে উঠে দরজা বন্ধ করার পর শান্ত হলেন মিস ভারনিয়া। নেতিয়ে পড়লেন গাড়ির সিটে।
.
মুসা আর কিশোরের অস্বস্তি বাড়ছে। থিয়েটারের ওপরতলায় এখন রয়েছে ওরা। লুকানর জায়গা খুঁজে পায়নি। নিতান্ত দরকার না পড়লে টর্চ জ্বালছে না। বাতাসে যেন জমাট বেঁধে আছে পুরানো ভাপসা গন্ধ। দানোরা আসছে কিনা বোঝা যাচ্ছে না, কোনরকম সাড়াশব্দ নেই কোথাও।
সরু করিডর ধরে একটা দরজার কাছে এসে দাঁড়াল দুই গোয়েন্দা, ঠেলা দিতেই খুলে গেল পাল্লা। ভেতরে ঢুকল ওরা। দরজাটা আবার বন্ধ করে দিয়ে টর্চ জ্বালল মুসা।
ঘরের ঠিক মাঝখানে মস্ত বড় দুটো মেশিন বসানো রয়েছে। প্রাচীন আমলের সিনেমা-প্রোজেকটর, ধুলো-ময়লায় একাকার, মরচে পড়ে বাতিল লোহায় পরিণত হতে চলেছে।
আরি, সিনেমাও দেখানো হত নাকি! এহ্, যা-মেশিন! মুখ বাঁকাল মুসা; মিউজিয়মে রাখার উপযুক্ত! কিশোরের দিকে ফিরল। এ-ঘরেই লুকিয়ে থাকা যাক।
বড় বেশি খোলামেলা! কতক্ষণ থাকতে হবে কে জানে! বিপদে পড়ব শেষে।