আরেকটা দানোকে ধরে মাথার ওপরে তুলে ছুঁড়ে ফেলল মুসা।
গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়াল দুই গোয়েন্দা, দুজনেই মুক্ত এখন। হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে। কব্জি থেকে দড়ি খুলে নিয়ে গুটিয়ে আবার কোমরে ঝোলাল কিশোর।
এখন কি করা, কিশোর? হাঁপাতে হাঁপাতে বলল মুসা।
দরজা খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের পেছনেই বোধহয় ওটা, এই যে এদিকে, মুসার হাত ধরে টানল কিশোর।
কয়েক পা এগোতেই দেয়াল ঠেকল হাতে। হাতড়াতে শুরু করল কিশোর। দরজার হাতলে আঙুল ঠেকতেই চেপে ধরে টান দিল। খুলল না দরজা, তালা। আটকানো।
আটকাই পড়লাম, বিষণ্ণ শোনাল কিশোরের গলা। ওভাবে এসে ঢুকে পড়াটা উচিত হয়নি, মুসা। উল্টে আমরাই ওদের ফাঁদে ধরা পড়লাম।
হ্যাঁ, কাজটা ঠিক হয়নি! তোমাকেও টেনে আনলাম এর মাঝে!
এটাই চাইছিল ওরা। যা হওয়ার হয়ে গেছে—ওই যে, শুনতে পাচ্ছ?
না শোনার কোন কারণ নেই, তীক্ষ্ণ শিস দিচ্ছে দানোরা। ডানেবায়ে দুদিকে।
আবার আক্রমণের জন্যে তৈরি হচ্ছে! চাপা গলায় বলল মুসা।
জলদি বেরোতে হবে এখান থেকে! আরও পথ থাকতে পারে।
থাকলেও অন্ধকারে খুঁজে বের করব কিভাবে?
আরে তাই তো, টর্চ! ভুলেই গিয়েছিলাম! ভয় এভাবেই আচ্ছন্ন করে মনকে…আছে, কোমরেই আছে।
মুসার টর্চও ঝোলানো আছে কোমরের বেল্টে। খুলে নিয়ে সুইচ টিপতেই অন্ধকার চিরে দিল তীব্র আলোকরশ্মি। আধ সেকেণ্ড পর কিশোরের টর্চ জ্বলে উঠল।
গায়ে আলো পড়তেই ছুটোছুটি করে লুকিয়ে পড়ার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠল খুলে মানুষগুলো। অদ্ভুত ভাষায় চিচি করে কি সব বলছে। অনেক বেশি সতর্ক এখন রত্নদানোরা। বুঝে গেছে, সহজে ছেলেদুটোকে কাবু করা যাবে না।
থিয়েটার মঞ্চের পেছনে রয়েছে দুই গোয়েন্দা। আয়তাকার কাঠের ফ্রেমে আটকানো ক্যানভাসের বড় বড় অসংখ্য ফ্ল্যাট একটার ওপর আরেকটা সাজিয়ে সারি দিয়ে রাখা হয়েছে। নানারকম ছবি, সিনসিনারি আঁকা ওসব ফ্ল্যাটে। নাটক অভিনয়ের সময় দৃশ্যপট পরিবর্তনের কাজে ব্যবহার হত ওগুলো। মই আর অন্যান্য কাজের জিনিস এখন পড়ে আছে অবহেলিত হয়ে পড়ে পড়ে নষ্ট হচ্ছে অনেক বছর। ধরে।
বাতাসে ডানা ঝাঁপটানর শব্দ, মাথার ওপর দিয়ে শব্দ করে উড়ে গেল একটা বাদুড়।
বাদুড়! চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
বাদুড়ে কামড়ায় না। চেঁচিও না অযথা। ওই যে, দেখ, দানোরা আসছে! চ্যালাকাঠকে লাঠির মত বাগিয়ে ধরে পায়ে পায়ে এগোচ্ছে খুদে মানুষেরা, সেদিকে দেখাল কিশোর। এখন যাই কোথায়?
এদিকে! ছোট! বলেই দুই সারি ফ্ল্যাটের মধ্য দিয়ে ছুটল মুসা।
কিশোরও ছুটল মুসার পেছনে। হঠাৎ থেমে মইটাকে এক টান মেরে ফেলে দিয়ে আবার ছুটল। তীক্ষ্ণ স্বরে চেঁচিয়ে উঠল এক দানো, বোধহয় গায়ের ওপর মই পড়েছে, কিংবা হোঁচট খেয়ে মাটিতে পড়ে গেছে ওটা। সেসব দেখার সময় নেই। এখন দুই গোয়েন্দার, ছুটছে প্রাণপণে।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল মুসা। সামনেও আছে দুটো! দুদিক থেকে আক্রমণের। তালে আছে!
দ্রুত এপাশ-ওপাশ দেখে নিল কিশোর। সারি দিয়ে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে অনেকগুলো ফ্ল্যাট। আঙুল তুলে দেখাল সে, ওগুলোর ভেতর দিয়ে যাব!
জোরে লাথি মারল কিশোর। ফড়াৎ করে ছিঁড়ে গেল পুরানো ক্যানভাস। মুসাকে নিয়ে ওটার ভেতরে ঢুকে পড়ল সে।
একের পর এক দৃশ্যপট ছিঁড়ে আরও ভেতরে ঢুকে চলল দুই গোয়েন্দা। পেছনে দুলছে ছেঁড়া ক্যানভাস। ওপাশে রয়েছে রত্নদানোরা, ওদেরকে দেখা যাচ্ছে না এখন, তবে চেঁচামেচি কানে আসছে।
কাঠের তৈরি বিশাল মঞ্চের কাছে চলে এল দুজনে। লাফিয়ে উঠে পড়ল। তাতে। সামনে আলো ফেলল। পুরানো, ধুলোমাখা নোংরা সিটের সমুদ্র চোখে পড়ল। ওগুলোর পেছনে নিশ্চয় দরজা রয়েছে। থাকলেও খোলা না বন্ধ কে জানে!।
পেছনে হালকা পায়ের শব্দ ছুটে আসছে। ঘুরে আলো ফেলল মুসা। পৌঁছে গেছে দানোরা।
দৌড়াও! চেঁচিয়ে বলল মুসা। দুই সারির মাঝখানের পথ ধরে ঢুকে পড়ব!
মঞ্চের একপাশের কাঠের সিঁড়ি বেয়ে হলের মেঝেতে নেমে পড়ল ওরা। ঠিক এই সময় জ্বলে উঠল হলের আলো, মেইন সুইচ অন করে দিয়েছে কেউ।
পেছনে তাকাল একবার কিশোর। হাতে চ্যালাকাঠ নিয়ে ছুটে আসছে দুটো খুদে মানুষ। ঝাড়বাতির রঙিন আলোয় অদ্ভুত দেখাচ্ছে দাননাদুটোকে। রত্নদানো
ছুটতে ছুটতে হাত বাড়িয়ে হঠাৎ ছাত থেকে ঝুলন্ত একটা দড়ি ধরে ফেলল এক দানো। জোরে এক দোল দিল দড়াবাজিকরের মত, চোখের পলকে উড়ে এসে পড়ল কিশোরের ঘাড়ে।
হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল কিশোর, হাত থেকে ছুটে গেল টর্চ। খোঁজার সময় নেই, গায়ে চেপে বসেছে দানো, ওটাকে ছাড়াতেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল সে।
টর্চটা একটা সিটের ওপর রেখে এগিয়ে এল মুসা। দানোর কোমড় আঁকড়ে ধরে হ্যাঁচকা টানে সরিয়ে নিল কিশোরের ওপর থেকে, গুঁজে দিল দুটো সিটের। মাঝখানের ফাঁকে। অসহায় ভঙ্গিতে ঝুলে থেকে হাত-পা ছুঁড়তে শুরু করল দানো, সাহায্যের জন্যে চেঁচাতে লাগল।
সঙ্গীকে সাহায্য করতে ছুটে এল দ্বিতীয় দালোটা। এই সুযোগে ছুটে গিয়ে একটা পথে ঢুকে পড়ল দুই গোয়েন্দা। ছুটল লবির দিকে।
বাইরে বেরোনর দরজার গায়ে প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ল দুজনে, ধাক্কা দিল। কিন্তু এক চুল নড়ল না বিশাল ভারি দরজা।
বাইরে থেকে তক্তা লাগিয়ে পেরেক মেরে রেখেছে! দমে গেল মুসা। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে। জানালা খুঁজে বের করতে হবে। কিশোর, এস।