বিছানায় সোজা হয়ে বসল মুসা। চোখ জানালার দিকে। গতি বেড়ে গেছে। হৃদযন্ত্রের, গলার কাছে ঠেলে উঠতে চাইছে কি যেন।
জানালায় উঁকি দিল একটা মুখ! _ খুদে একটা মুখ, লাল চোখ, রোমশ কান, সারকাসের ক্লাউনের মত চোখা লম্বা নাক। ছোট ছোট ঠোঁট সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে চোখা দত্ত, ভেঙচি কাটছে যেন।
হঠাৎ ঘরে যেন বিদ্যুৎ চমকে উঠল, লাফিয়ে খাট থেকে নামল মুসা। চোখের পলকে নেই হয়ে গেল মুখটা।
তুলেছি! অন্ধকার কোণ থেকে চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। মুসা, তুলে ফেলেছি!
ওই ব্যাটা রত্নদানো, কোন সন্দেহ নেই! মুসাও চেঁচিয়ে বলল।
ছবি তুলে ফেলেছি। এখন ধরতে হবে ব্যাটাকে!
জানালার কাছে এসে দাঁড়াল দুজনে। চোখ মিটমিট করে তাকাল নিচে আঙিনার দিকে। কৃষ্ণপক্ষের একফালি চাঁদের ঘোলাটে আলোয় দেখা গেল, চারটে খুদে মূর্তি পাগলের মত নাচানাচি করছে। নাচছে কুদছে, এ-ওর ঘাড়ে পড়ছে, ডিগবাজি খাচ্ছে। উল্লাসে ফেটে পড়ছে, যেন সারকাসের কয়েকটা ক্লাউন।
.
ফ্ল্যাশগানের আলো চোখ ধাঁধিয়ে দিয়েছিল, ধীরে ধীরে আবার আবছা অন্ধকার সয়ে এল দুই গোয়েন্দার চোখে। মূর্তিগুলোকে আরও স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে এখন। দানোদের মুখের সাদা রঙও দেখতে পাচ্ছে। পরনে চামড়ার পোশাক, পায়ে চোখা জুতো।
কিশোর, ফিসফিস করে বলল মুসা। আঙিনায় খেলা জুড়েছে কেন ব্যাটারা?
খুব সহজ কারণ, জুতোর ফিতে বাধছে গোয়েন্দাপ্রধান। আমাদেরকে ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চায়।
ভয়? তা দেখাতে পেরেছে, অন্তত আমাকে তো বটেই। কিন্তু কেন? সুড়ঙ্গ খোঁড়া বাদ দিয়ে মানুষের পেছনে লেগেছে কেন?
ওদের ভাড়া করে আনা হয়েছে। কাজটা বোধহয় মিস ভারনিয়ার ভাইপোর।
বব! জুতোর ফিতে বাঁধতে বাঁধতে হাত থেমে গেল মুসার। কেন?
ভয় পেয়ে যাতে বাড়িটা বিক্রি করে দেন মিস ভারনিয়া। পটিয়েপাটিয়ে ফুফুর কাছ থেকে তখন প্রচুর নগদ টাকা আদায় করে নিতে পারবে বব।
ঠিক, ঠিক বলেছ কিশোর। এখন বুঝতে পারছি সব ববের শয়তানি!
এবং সেটা প্রমাণ করা দরকার। অন্তত একটা দানোকে ধরতেই হবে।
ব্যাগ থেকে দড়ির বাণ্ডিল বের করে কোমরে ঝোলাল কিশোর। একজোড়া দস্তানা মুসাকে দিয়ে আরেক জোড়া নিজে পরল। ক্যামেরা ঝুলিয়ে নিল কাঁধে। যার যার কোমরের বেল্টে ঝুলিয়ে টর্চ নিল দুটো, হাত মুক্ত রাখল।
কিন্তু জানালায় উঁকি দিল কি করে রত্নদানো? প্রশ্ন করল মুসা। দোতলার জানালা—
ভালমত ভাব, বুঝে যাবে। এখন চল যাই। মিস ভারনিয়া হয়ত ঘুমিয়ে আছেন, তাঁকে ডাকার দরকার নেই। চেঁচামেচি শুরু করলে দানোরা পালাবে।
নিচতলার বারান্দায় বেরিয়ে এল দুজুনে। ছায়ার মত নিঃশব্দে চলে এল বাড়ির এক কোণে। দেয়ালের সঙ্গে প্রায় লেপটে থেকে মুখ বাড়িয়ে উঁকি দিল।
উঠনে এখনও লাফালাফি করছে চার দানো।
ধর, মুসার হাতে দড়ির এক প্রান্ত খুঁজে দিল কিশোর। আরেক মাথা নিজের কব্জিতে পেঁচিয়ে বাধল। দড়ি টান টান করে ধরে দৌড় দেবে, যার গায়েই দড়ি বাঁধুক পেঁচিয়ে ফেলবে সঙ্গে সঙ্গে। দাও দৌড়!
একসঙ্গে দৌড় দিল দুজনে। একটা ঝোঁপের ধার দিয়ে যাওয়ার সময় ডালে আটকে গেল হঠাৎ কিশোরের কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরার বেল্ট, খাপসহ ছিঁড়ে পড়ে গেল ক্যামেরা, কিন্তু থামল না সে।
ছেলেদেরকে আসতে দেখল রত্নদানোরা। তীক্ষ্ণ শিস দিয়ে উঠে ছড়িয়ে ছিটিয়ে দৌড় দিল দেয়ালের ছায়ার দিকে।
থেম না, মুসা! চেঁচিয়ে বলল কিশোর। একটাকে অন্তত ধরা চাই!
একটা খুদে মূর্তির কাঁধ খামচে ধরল মুসা, কিন্তু ধরে রাখতে পারল না, ঝট করে বসে পড়েছে দানোটা। তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে। কিশোরও ছুটে এসে হোঁচট খেয়ে পড়ল মুসার গায়ের ওপর। তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়াল আবার দুজনেই। চকিতের জন্যে দেখল, থিয়েটার-বাড়ির দিকে ছুটে পালাচ্ছে দানাগুলো।
গেট! হাঁপাচ্ছে কিশোর। খোলা!
বাড়িতে ঢুকে পড়েছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। কিশোর, জলদি এস!
মুসা, দাঁড়াও! ডাকল কিশোর। একটা ব্যাপার… আর কিছু বলার আগেই হাতের কবজিতে হ্যাঁচকা টান পড়ল, বাধ্য হয়েই তাকেও মুসার পিছু নিতে হল।
থিয়েটারে আগুন লাগলে কিংবা অন্য কোনরকম জরুরি অবস্থার সৃষ্টি হলে, বেরোনর জন্যে একটা ইমার্জেন্সী ডোর রাখা হয়েছিল, সেটা এখন খোলা। সেদিক দিয়েই ভেতরে ঢুকেছে দানোরা। মুসাও ঢুকে পড়ল সেই দরজা দিয়ে।
মুসার সঙ্গে তাল রাখতে হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে কিশোর। গতি কমাতেও পারছে না, তাহলে টানের চোটে হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়তে হবে। মুসার পেছনে বাড়ির ভেতরের গাঢ় অন্ধকারে ঢুকে পড়ল সে-ও। পেছনে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। দরজা। আটকা পড়ল দুই গোয়েন্দা। মুহূর্ত পরেই চারপাশ থেকে আক্রান্ত হল ওরা। চোখা তীক্ষ্ণ অনেকগুলো নখ খামচে ধরল ওদেরকে।
১১.
বাঁচাও! বাঁচাও! চেঁচাতে লাগল মুসা। দানোরা মেরে ফেলল আমাকে!
আমাকেও ধরেছে! গুঙিয়ে উঠল কিশোর। দুহাতে মেরে গায়ের ওপর থেকে সরানর চেষ্টা করল খুদে মানুষগুলোকে। আমাকে আটকে ফেলেছে!
এখনও দড়ি ধরে রেখেছে মুসা, কি ভেবে হ্যাঁচকা টান মারল কিশোর। চেঁচিয়ে উঠল এক দানো, দড়িটা প্রচণ্ড জোরে বাড়ি মেরেছে তার গলায়।
চমকে গেল দানোরা।
ক্ষণিকের জন্যে গায়ে চাপ কমে গেল, সুযোগটার সদ্ব্যবহার করল কিশোর। ঝাড়া মেরে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে চলে এল মুসার কাছাকাছি। হাতে একটা চামড়ার জ্যাকেট ঠেকতেই খামচে ধরে হ্যাঁচকা টান মারল, একটানে দানোটাকে সরিয়ে আনল মুসার গায়ের ওপর থেকে, প্রায় ছুঁড়ে ফেলে দিল একপাশে। মেঝেতে পড়ে তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল দানোটা।