পকেট থেকে নীল চক বের করে দেখাল মুসা। কিশোর এনেছে সাদা চক।
না, আর কিছু বাকি নেই, খুশি হয়ে বলল কিশোর। টুথব্রাশ এনেছ?
পাশে রাখা ছোট হ্যাণ্ডব্যাগটা দেখাল মুসা। পাজামাও এনেছি। রাতে থাকব, ওসব তো দরকার।
পাজামা লাগবে না। রাতে তো আর ঘুমাচ্ছি না। কাপড়চোপড় সব পরে বসে থাকব, রত্নদানো এলেই যেন ছুটে গিয়ে খপ করে ধরতে পারি।
আর চুপ থাকতে পারল না বোরিস। দানো ধরার জন্যে তৈরিই হয়ে এসেছ একেবারে! সাবধান, খুব খারাপ জীব ওরা। বিকেলে রোভারের সঙ্গেও আলাপ করেছি, ও আমার সঙ্গে একমত। রত্নদানোরা খারাপ, বিশেষ করে ব্ল্যাক ফরেস্টেরগুলো তো একেকটা সাক্ষাৎ ইবলিস। ওদের চোখের দিকে সরাসরি। তাকিও না, পাথর হয়ে যাবে!
এতই আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথাগুলো বলল বোরিস, অস্বস্তি বোধ করতে লাগল মুসা। রত্নদানো বাস্তবে নেই, এতক্ষণ যে ধারণাটা ছিল, সেটা বদলে গেল মুহূর্তে। বোরিস বলছে, রত্নদানো আছে, রোভারও বিশ্বাস করে, মিস ভারনিয়া নাকি। দেখেছেন, এমনকি রবিনও দেখেছে। এতগুলো লোক,
কিশোরের কথায় মুসার ভাবনায় ছেদ পড়ল। কিন্তু, বোরিস, মিস ভারনিয়াকে সাহায্য করব কথা দিয়ে ফেলেছি আমরা। এখনও জানি না, সত্যি রত্নদানোরাই বিরক্ত করছে তাকে, নাকি অন্য কিছু। তাছাড়া, কি ধরনের রহস্য নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করে তিন গোয়েন্দা…
যে কোন ধরনের উদ্ভট রহস্য… বলতে বলতে থেমে গেল মুসা। এই রত্নদানোর ব্যাপারটা উটের চেয়েও উদ্ভট হয়ে যাচ্ছে না তো?
.
১০.
মিস ভারনিয়ার আঙিনা অন্ধকার। নির্জন ব্যাংক আর পোডড়া থিয়েটার-বাড়িটাকে যেন গিলে ফেলেছে গাঢ় অন্ধকার। সরু বাড়ির একটা ঘরে আলো জ্বলছে, তার মানে অপেক্ষা করছেন লেখিকা, জেগে আছেন গোয়েন্দাদের অপেক্ষায়।
ট্রাক থেকে নেমে এল কিশোর আর মুসা।
জানালার বাইরে মুখ বের করল উদ্বিগ্ন বোরিস। কিশোর, আবার বলছি, রত্নদানো ধরার চেষ্টা কোরো না। ব্ল্যাক ফরেস্টে অনেক পুরানো গুঁড়ি আর পাথর দেখেছি, এক সময় ওরা জ্যান্ত মানুষ ছিল। রত্নদানোরা ওদের ওই অবস্থা করেছে। খবরদার, ওদের চোখে চোখে চেও না কিছুতেই!
গাঢ় বিশ্বাস বোরিসের। মুসার ভাল লাগছে না ব্যাপারটা। অস্বস্তি বোধ বাড়ছে। অবচেতন মন হুঁশিয়ার করে দিল, সামনে রাতটা ভাল যাবে না।
বোরিসকে বিদায় জানাল কিশোর। কথা দিল, হুশিয়ার থাকবে, যাতে তাকে পাথর না বানাতে পারে রত্নদানোরা। বলল, সকালে রবিনের কাছে ফোন করবে, তখন যেন তাকে সহ ট্রাক নিয়ে চলে আসে।
বেড়ার ধার ঘেঁষে গেটের দিকে এগোল দুই গোয়েন্দা। আড়াল থেকে কেউ তাদের ওপর চোখ রাখছে না তো? কি জানি! এত অন্ধকার, প্রায় কিছুই দেখা যায় না।
হাতড়ে হাতড়ে গেটের পাশে লাগানো বেলপুশটা বের করে একবার টিপল কিশোর। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই গুঞ্জন উঠল গেটের মেকানিজমে। খুলে গেল পাল্লা, দুই গোয়েন্দা আঙিনায় ঢুকে পড়তেই আবার বন্ধ হয়ে গেল।
থমকে দাঁড়িয়ে কান পাতল কিশোর। অবাক লাগছে মুসার, এত সাবধানতা কেন? বিপদ সত্যি আশা করছে গোয়েন্দাপ্রধান? নাকি অযথাই অতিরিক্ত নাটকীয়। করে তুলছে পরিস্থিতিকে। কিন্তু তেমন স্বভাব তো নয় কিশোরের! ভয় পেল মুসা।
অন্ধকার আঙিনা। নিঃশব্দে কিশোরের পেছনে এগোল মুসা। সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠল। দরজার পাল্লা ভেজানো, ঠেলা দিতেই খুলে গেল, ভেতরে ঢুকে পড়ল দুজন।
শুকনো, ফেকাসে মুখে দুই গোয়েন্দাকে স্বাগত জানালেন মিস ভারনিয়া। হাঁপ ছেড়ে বললেন, তোমরা এসে পড়েছ, ভাল হয়েছে। জীবনে এই প্রথম এত নার্ভাস ফীল করছি। যা ঘটেছে, এর চেয়ে বেশি কিছু ঘটলে আর থাকব না এ-বাড়িতে, এবার ঠিক পালাব। রবার্টের কাছে বাড়ি বেচে দিয়ে দূরে কোথাও চলে যাব।
এত ভেঙে পড়ার কিছু নেই, মিস ভারনিয়া, কোমল গলায় বলল কিশোর। আমরা তো আছি।
কেমন এক ধরনের কাঁপা হাসি ফুটল লেখিকার ঠোঁটে। রাত বেশি হয়নি। মাঝরাতের আগে ওরা আসে না। এতক্ষণ কি করবে? বসে বসে টেলিভিশন দেখ।
বরং একটু ঘুমিয়ে নিই, বলল কিশোর। এই সাড়ে এগারোটা নাগাদ উঠে পড়ব। তাজা শরীর নিয়ে খুব আরামে পাহারা দিতে পারব বাকি রাতটা।
আরাম! আশ্চর্য! বিড়বিড় করল মুসা।
সহকারীর কথায় কান না দিয়ে বলল কিশোর, টেবিল ঘড়ি আছে আপনার? অ্যালার্ম ক্লক?
আছে।
সিঁড়ির মাথায় ছোট ঘরটা দুই গোয়েন্দাকে দেখিয়ে দিলেন মিস ভারনিয়া। দুটো বিছানা করে রেখেছেন। টেবিলে ব্যাগ রেখে শুধু জুতো খুলে সটান বিছানায় শুয়ে পড়ল কিশোর।
মুসাও শুলল। খানিকক্ষণ গড়াগড়ি করে এক সময় সে-ও ঘুমিয়ে পড়ল। তার মনে হল, চোখ বোজার সঙ্গে সঙ্গেই বেজে উঠেছে হতচ্ছাড়া ঘড়ির বেল।
কটা বাজল? চোখ না খুলেই বিড়বিড় করল মুসা।
সাড়ে এগারো, চাপা গলায় বলল কিশোর। মিস ভারনিয়া শুয়ে পড়েছেন। বোধহয়। তুমি আরও খানিকক্ষণ ঘুমিয়ে নিতে পার। আমি পাহারায় থাকছি।
পাহারা! বিড়বিড় করল আবার মুসা, কয়েক সেকেণ্ডেই ঘুমিয়ে পড়ল।
রবিনের মতই দুঃস্বপ্ন দেখতে শুরু করল মুসা। স্বপ্নের মাঝেই কানে এল জানালায় টোকার শব্দ।
ঘুম ভেঙে গেল মুসার, পলকে পুরো সজাগ। টোকার শব্দ হচ্ছে এখনও। তালে তালে একটা বিশেষ ছন্দে এক…তিন—দুই-তিন—এক। কোনরকম সঙ্কেত? নাকি জাদু করছে রত্নদানোরা…