যেন ভাজা মাছটি উল্টে খেতে জানে না, এমনি চেহারা করে দাঁড়িয়ে রইল কিশোর।
আরেকজন এসে দাঁড়াল, রোগা শরীর, পাতলা চুল। আরে, বার্ট, কি করছ? খালি বাড়ি, তাই সন্দেহ হয়েছে ওদের। হতেই পারে।
ওদের ভাবসাব পছন্দ হচ্ছে না আমার, মিস্টার রবার্ট! বার্টের গলায় সন্দেহ।
আচ্ছা দাঁড়াও, আমি কথা বলছি, এগিয়ে এল দ্বিতীয় লোকটা। আমি জন রবার্ট। এই বাড়ির মালিক। ভাঙচুর চলছে, নতুন করে বাড়ি তৈরি করব, তাই মাঝে মাঝে দেখতে আসি। এ হল বার্ট ইঅং, আমার দারোয়ান। তা তোমাদের কেন সন্দেহ হল ভেতরে চোর ঢুকেছে?
গেটে তালা… শুরু করল কিশোর, কিন্তু তার কথার মাঝেই বলে উঠল মুসা, গোল্ডেন বেল্ট শব্দটা কানে এল! সন্দেহ জাগল আমাদের। আরও ভালমত কান পাতলাম, মিউজিয়ম শব্দটাও শুনলাম। ধরেই নিলাম বেল্ট চুরি করে এখানে ঢুকেছে। চোরেরা!
মিস্টার রবার্ট, গম্ভীর গলায় বলল ইঅং। ছেলেগুলোর মাথায় হয় গোলমাল আছে, নইলে চোর। আমি যাই, পুলিশ নিয়ে আসি।
থাম! ধমক দিল রবার্ট। তুমি কি বোঝ?…আচ্ছা, গোল্ডেন বেল্ট…! হঠাৎ কি মনে পড়ে যাওয়ায় হাসল সে। অ-অ, বুঝেছি! মনে পড়েছে। আমি আর বার্ট পরামর্শ করছিলাম থিয়েটারটা ভেঙে ফেলার আগেই গোল্ড অ্যাও গিল্টগুলো সরিয়ে ফেলব। সোনালি রঙ করা কিংবা গিলটি করা অনেক কারুকাজ, অনেক নকশা রয়েছে এখানে, একেবারে মিউজিয়মের মত মনে হয়। গোল্ড অ্যাণ্ড গিল্টকেই তোমরা গোল্ডেন বেল্ট শুনেছ। বুঝতে পারছি, গোল্ডেন বেল্ট চুরির ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা ঘামাচ্ছ তোমরা। হাসল সে।
গোমড়া মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ইঅং। খুব বেশি কল্পনা করে বিচ্ছুগুলো।
তোমার কি? কড়া গলায় বলল রবার্ট। খাও আর ঘুমাও। কল্পনা করবে কখন? কোন কিছু তোমাকে নাড়া দেয় নাকি? এই যে গত কয়েক রাতে কি সব শব্দ হল, ভয়ে পালাল দুজন নাইট গার্ড, কেন কি হল, একবারও ভেবেছ?
শব্দ? আগ্রহী হয়ে উঠল কিশোর। কেমন শব্দ?
কি জানি! ওরা বলল, ভূতে নাকি দরজায় টোকা দেয়, গোঙায়, বলল রবার্ট। আসলে, বাড়িটা পুরানো, ঢুকলে এমনিতেই গা ছমছম করে। অন্ধকারে নানারকম শব্দ হয়। কেন হয় দেখতে চাও? এস আমার সঙ্গে। গোল্ড অ্যাণ্ড গিল্টও দেখতে পাবে। দেখবে?
তিনজনই বলল, দেখবে।
বার্ট, মেইন লাইনটা দিয়ে দাও তো। এস, তোমরা আমার সঙ্গে এস। আগে। আগে অন্ধকার একটা গলি ধরে এগোল রবার্ট। পেছনে অনুসরণ করল ছেলেরা।
অন্ধকারে কিছু একটা রবিনের গাল ছুঁয়ে গেল, চেঁচিয়ে উঠল সে, বাদুড়!
হ্যাঁ, অন্ধকার থেকে ভেসে এল রবার্টের গলা। অনেক বছর খালি পড়ে আছে বাড়িটা। বাদুড় আর ইঁদুরের আড়া! ওরাই রহস্যময় শব্দ করে। একেকটা ইঁদুর যা বড় না, বেড়াল খেয়ে ফেলতে পারবে!
ঢোক গিলল রবিন, চুপ করে রইল। অসংখ্য বাদুড়ের ডানা ঝাঁপটানর শব্দ কানে আসছে। মাঝে মাঝে তীক্ষ্ণ কিচকিচ আওয়াজ হচ্ছে, শিরশির করে ওঠে গা।
হঠাৎ গ ই-ই-চ করে উঠল কিসে যেন। চমকে উঠল ছেলেরা।
ভয় পাচ্ছ? অন্ধকারেই বলল রবার্ট। ও কিছু না। পর্দা টানার জন্যে, নানারকম সিনসিনারির ছবি ঝোলানর জন্যে পুলি আর মোটা দড়ি ব্যবহার হত, ছিঁড়ে গেছে বেশির ভাগই, পুলিতে মরচে পড়েছে। দড়িগুলোতে বাদুড় ঝুললেই টান পড়ে, বিচিত্র শব্দ হয়।…অহ, এতক্ষণে আলো জ্বলল।
মাথার ওপর বিশাল এক ঝাড়বাতি জ্বলে উঠেছে, সবুজ, লাল, হলুদ আর নীল কাঁচের ফানুসগুলোতে বালি যেন লেপটে রয়েছে। এমনিতেই কম পাওয়ারের বাল্ব। ওগুলোর ভেতরে, তার ওপর বালিতে ঢাকা পড়ায় আলো তেমন ছড়াচ্ছে না। অদ্ভুত এক রঙিন আলো-আঁধারির সৃষ্টি হয়েছে হলের ভেতরে। আবছামত দেখা যাচ্ছে। ঘরের জিনিসপত্র। এক প্রান্তে মস্তবড় মঞ্চ। চারপাশে শুধু সিট আর সিট। বিরাট থিয়েটার ছিল এককালে।
হলের দুপাশের দেয়ালে বড় বড় জানালা, তাতে সোনালি সুতোয় নকশা করা লাল মখমলের ভারি পর্দা ঝুলছে। দেয়ালে দেয়ালে নানা রকমের চিত্র, নাইট আর সারাসেনদের লড়াইয়ের দৃশ্য, যোদ্ধাদের পরনে সোনালি বর্ম। ঠিকই বলেছে রবার্ট, গোল্ড অ্যাণ্ড গিল্ট-এর ছড়াছড়ি। হলের ভেতরের পরিবেশও মিউজিয়মের মত।
উনিশশো বিশ সালে তৈরি হয়েছিল এই থিয়েটার, বলল রবার্ট। মূরেরা তৈরি করেছিল। এ-ধরনের জাকজমক তখন পছন্দ করত লোকে। বাইরে থেকে দেখেছ না, কেমন দুর্গদুর্গ লাগে? এটাও তখনকার দর্শকদের পছন্দ ছিল। আজকাল তো এসব জায়গায় লোকে ঢুকতেই চাইবে না, কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসে!
ফিরে যাওয়ার জন্যে ঘুরল রবার্ট। হঠাৎ একটা চেয়ারের হাতলে লাফিয়ে উঠল কালচে-ধূসর রোমশ একটা জীব, ছোটখাট একটা বেড়াল বললেই চলে।
আমাদের একজন বাসিন্দা, ইঁদুরটাকে দেখে হেসে বলল রবার্ট। অনেক বছর ধরে বাস করছে, তাড়াতে বহুত কষ্ট হবে।
আগের ঘরটায় ফিরে এল ওরা। তারপর, মূরিশ থিয়েটারের ভেতর তো দেখলে। বাড়িটা ভাঙা হবে যেদিন, সেদিন এস। সে এক দেখার ব্যাপার। কয়েক হপ্তার মধ্যেই ভাঙব। গুডবাই, অ্য।
ছেলেরা বাইরে বেরোতেই পেছনে বন্ধ করে দেয়া হল দরজা। ছিটকিনি তুলে দেয়ার শব্দ কানে এল ওদের।
বাপরে বাপ! ফোঁস করে শ্বাস ফেলে বলল মুসা। কি একেকখান ইঁদুর! বেড়াল কি, হাতিও খেয়ে ফেলবে! এ-জন্যেই পালিয়েছে নাইট গার্ডরা।