হৈ-চৈ করে মিস ভারনিয়ার বাড়ি থেকে বেরিয়ে এল তিন গোয়েন্দা। আড়াল থেকে তাদের ওপর কেউ চোখ রেখে থাকলে, সে নিশ্চয় দেখতে পেয়েছে।
গেটের বাইরে এসেই প্রশ্ন করল মুসা, কিশোর, সব কিছুই মহিলার অনুমান নয়ত?
জানি না, চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল গোয়েন্দাপ্রধান। হতেও পারে। কিন্তু মহিলার ব্যবহারে মনে হল না, মাথায় কোন গোলমাল আছে। হয়ত সত্যিই রত্নদানোদের দেখেছেন!
দূরর! রত্নদানো থাকলে তো দেখবে?
থাকতেও পারে। লোকে তো বিশ্বাস করে!
লোকে তো ভূতও বিশ্বাস করে।
জবাব দিল না কিশোর।
রবিন বলল, বিশ্বাস অনেক সময় সত্যিও হয়ে যায়। ১৯৩৮ সালে আফ্রিকার উপকূলে একটা আজব মাছ ধরা পড়েছিল। তার আগে বিজ্ঞানীদের ধারণা ছিল, কোটি কোটি বছর আগে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ওই মাছ। কোয়েলাকান্থ ওর নাম। একটা দুটো নয়, হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ কোয়েলাকান্থ বেঁচে আছে আজও, ঘুরে বেড়াচ্ছে সাগরের তলায়। তাহলে? লেকচার দেয়ার সুযোগ পেয়ে গেছে রবিন। ধর, অনেক অনেক বছর আগে হয়ত বামন মানুষেরা পৃথিবীতে রাজত্ব করত। তারপর একদিন এল লম্বা মানুষেরা, ওদের ভয়ে ছোট মানুষেরা গিয়ে। লুকাল মাটির তলায়। অনেকেই মরে গেল, কিন্তু কেউ কেউ মাটির তলায় বাস করাটা রপ্ত করে নিল। ব্যস, টিকে গেল ওরা। হয়ত কোয়েলাকান্থের মতই আজও টিকে আছে ওরা। তাদের নাম রত্নদানো কিংবা বামন কিংবা খাটোভূত হতে দোষ কি?
চমৎকার থিওরি, হাসল কিশোর। দেখা যাক, আজ রাতে রত্নদানো ধরা পড়ে কিনা। পৃথিবী-বিখ্যাত হয়ে যাব আমরা রাতারাতি।
পথে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে কেবল কিশোর।
অধৈর্য হয়ে উঠল মুসা। কী দাঁড়িয়ে আছ চুপচাপ! চল বাড়ি যাই। খিদে পেয়েছে।
তোমার পেটে রাক্ষস ঢুকেছে! সহকারীকে মৃদু ধমক দিল গোয়েন্দাপ্রধান! এস, আগে পুরো ব্লকটা ঘুরে দেখি। পাতাবাহার আর কাঠের বেড়া শুধু ভেতর থেকে দেখেছি, বাইরে থেকে একবার দেখি।
রত্নদানোরা কোন্ পথে বেরোয়, সেটা দেখতে চাইছ? রবিন বলল।
হা। তখন তাড়াহুড়োয় হয়ত চোখ এড়িয়ে গেছে। ভাল করে দেখলে পথটা পেয়েও যেতে পারি।
থিয়েটার-বাড়ির একপাশ থেকে শুরু করল ওরা। খিদের কথাটা আকারে ইঙ্গিতে আরেকবার জানাল মুসা। হেসে ফেলল কিশোর আর রবিন। শিগগিরই বাড়ি যাবে, কথা দিয়ে, কাজ শুরু করল কিশোর।
থিয়েটারের সদর দরজা তক্তা লাগিয়ে আটকে দেয়া হয়েছে। তার ওপর লাগানো হয়েছে কন্ট্রাকটরের সাইনবোর্ড। মোড় ঘুরে সরু গলিপথটায় এসে ঢুকল তিন গোয়েন্দা, মিস ভারনিয়ার বাড়ির পেছন দিয়ে যেটা গেছে সেটাতে। খানিক দূর এগিয়েই একপাশে একটা লোহার গেট পড়ল, থিয়েটার-বাড়ির পেছনের গেট। পাল্লা কয়েক ইঞ্চি ফাঁক হয়ে আছে, তারমানে খোলা। ভেতর থেকে হঠাৎ ভেসে এল মানুষের গলা।
আশ্চর্য তো! গেটের পাল্লায় লাগানো বোর্ডের দিকে চেয়ে আছে কিশোর। নোটিশ ঝুলিয়েছে বন্ধ, অথচ খোলা!
নিশ্চয় ভূতেরা কথা বলছে, বিড়বিড় করে বলল মুসা। নইলে এখানে মরতে আসবে কে? এই সময়?
সঙ্গীদের নিয়ে গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকে পড়ল কিশোর। সিঁড়ি, তারপর আরেকটা দরজা। দরজার কপালে লেখা স্টেজডোর। রঙ চটে গেছে, কিন্তু পড়া যায়।
পাথরের সিঁড়িতে বসে পড়ল কিশোর। ভেতর থেকে আর কথা শোনা যায়। কিনা তার অপেক্ষা করছে। একবার খুলছে আবার বাঁধছে জুতোর ফিতে। দুজন মানুষের চাপা গলায় কথা শোনা গেল আবার।
শুনছ… শুরু করেই থেমে গেল মুসা।
শশশশ! ঠোঁটে আঙুল রাখল কিশোর। ফিসফিস করে বলল, গোল্ডেন বেল্ট শব্দটা বুঝতে পেরেছি!
গোল্ডেন বেল্ট! মানে… বলতে গিয়ে বাধা পেল রবিন।
আস্তে! কান খাড়া করে ঘরের ভেতরের কথা বোঝার চেষ্টা করছে কিশোর। মিউজিয়ম শব্দটাও শুনলাম!
ইয়াল্লা! ফিসফিস করল মুসা, চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। কি খুঁজতে এসে কি পেয়ে যাচ্ছি! পুলিশ ডেকে আনব নাকি?
ভালমত বুঝে নিই, তারপর ডাকা যাবে, উঠে গিয়ে দরজায় কান পাতল কিশোর।
রবিন আর মুসাও এসে দাঁড়াল দরজার কাছে। আবার মিউজিয়ম শব্দটা বলা। হল, এবার শুনল তিনজনেই। গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে দরজায় কান পাতল ওরা। পাল্লা ভিড়িয়ে রাখা হয়েছে শুধু, ঠেলা লাগল, খুলে গেল হাঁ হয়ে। বেশি হেলে ছিল কিশোর, হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল সে। পড়ার আগে মুসার কাপড় খামচে ধরে পতন। রোধের চেষ্টা করল, পারল তো না-ই, মুসার ভারসাম্যও নষ্ট করে দিল। গোয়েন্দা সহকারীও পড়ল, এবং পড়ল রবিনকে নিয়ে।
হাঁচড়ে-পাঁচড়ে উঠে দাঁড়ানর চেষ্টা করল ওরা। ঠিক এই সময় মুসা আর রবিনের কলার চেপে ধরল ভারি থাবা। চোর! গর্জে উঠল লোকটা। মিস্টার রবার্ট, চোর! কয়েকটা ছেলে ঢুকেছে চুরি করতে।
.
০৭.
গাঁট্টাগোট্টা একজন লোক। কালো ঘন ভুরু। চোখ মুখ পাকিয়ে রেখেছে। কলার ধরে টেনে তুলল সে রবিন আর মুসাকে। ব্যাটারা! এইবার পেয়েছি! মিস্টার রবার্ট, আরেকটা রয়েছে! জলদি এসে ধরুন!
কিশোর, পালাও! চেঁচিয়ে বলল মুসা। বোরিসকে নিয়ে এস!
পালাল না কিশোর, দাঁড়িয়ে রইল। ভুল করছেন আপনি, নিরীহ গলায় লোকটাকে বলল সে। খালি বাড়িতে কথার আওয়াজ পেয়ে অবাক লাগল, তাই দেখতে এসেছি। আমরাই বরং ভেবেছি, চোর ঢুকেছে।
তাই, না? কড়া চোখে লোকটা তাকাল কিশোরের দিকে। চোর ঢুকেছে ভেবেছ?