…রত্নদানোরা ছাড়া! বাক্যটা সমাপ্ত করে দিল মুসা।
হ্যাঁ, রত্নদানো ছাড়া! মাথা ঝাঁকালেন মিস ভারনিয়া। উঠে জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম! ওমা! আঙিনায় চারটে খুদে মানুষ! একেবারে ছবিতে যে-রকম দেখেছি, তেমনি পোশাক পরা। লাফাচ্ছে ওরা, নাচানাচি করছে, খেলছে আনন্দে! ডাকলাম। সঙ্গে সঙ্গে ভোজবাজির মত গায়েব হয়ে গেল জীবগুলো! ছেলেদের মুখ দেখে বোঝার চেষ্টা করলেন লেখিকা, তার কথা বিশ্বাস করছে কিনা ওরা। আমি স্বপ্ন দেখিনি। পরের দিন পরিচিত এক কনস্টেবলকে রাস্তায় দেখে তাকে ডেকে বললাম সব কথা। কি একখান চাউনি যে দিল আমাকে! আহ, যদি দেখতে! ক্ষণিকের জন্যে ঝিক করে উঠল মহিলার নীল চোখের তারা। আমাকে উপদেশ দিল ব্যাটা! নিজের শরীরের প্রতি খেয়াল রাখতে বলল। শিগগিরই বাইরে কোথাও গিয়ে বেড়িয়ে আসতে বলল। ওকেও আচ্ছামত কথা শুনিয়েছি আমি। ওর সামনেই প্রতিজ্ঞা করেছি, রত্নদানোর কথা আর কক্ষণো বলব না পুলিশকে।
এক মুহূর্ত চুপ থেকে হঠাৎ হেসে উঠলেন মিস ভারনিয়া। আসলে পুলিশেরও দোষ দেয়া উচিত না। রাতদুপুরে রত্নদানো দেখেছি, একথা বললে কে বিশ্বাস করতে চাইবে? যাই হোক, সেদিন জোর করেই মনকে বোঝালাম, রত্নদানো দেখিনি। ওসব আমার কল্পনা। দ্বিতীয় রাত গেল, কিছু ঘটল না। তৃতীয় রাতে আবার দেখলাম ওদের। একই সময়ে, একই জায়গায়। তাড়াতাড়ি ফোন করে বললাম আমার এক ভাইপোকে। বব, আমার একমাত্র ঘনিষ্ঠ আত্মীয়। বিয়ে করেনি এখনও, মাইল কয়েক দূরে একটা অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে থাকে সে। ওকে অনুরোধ করলাম আসতে। অবাক হল, কিন্তু আসবে বলে কথা দিল। ভাঁড়ারে দানোদের হুটোপুটির আওয়াজ পেলাম। টর্চটা নিয়ে পা টিপে টিপে নিচে নামলাম, এগোলাম ভাঁড়ারের দিকে। যতই এগোলাম, শব্দ আরও স্পষ্ট হতে থাকল। ঘরে ঢুকেই টর্চের সুইচ টিপে দিলাম। কি দেখলাম জান?
মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছে তিন ছেলে। একই সঙ্গে বলে উঠল, কী!
তিনজনের দিকেই একবার করে তাকালেন মিস ভারনিয়া। স্বর খাদে নামিয়ে বললেন, কিছু না!
চেপে রাখা শ্বাস শব্দ করে ছাড়ল রবিন। পুরোপুরি হতাশ হয়েছে।
হ্যাঁ, প্রথমে কিছু না! আবার বললেন মিস ভারনিয়া। টর্চ নিভিয়ে দিলাম। আবার ওপরে উঠে যাওয়ার জন্যে ঘুরতেই দেখলাম ওটাকে। ছোট একটা মানুষের। মত জীব, ফুট তিনেক লম্বা। চামড়ার টুপি, চামড়ার কোট-প্যান্ট, চোখা মাথাওয়ালা জুতো। নোংরা দাড়ি, বোধহয় মাটি লেগেছিল। এক হাতে একটা গাঁইতি কাঁধে ধরে রেখেছে, আরেক হাতে মোমবাতি। মোমের আলোয় ওর চোখ দেখতে পেলাম, টকটকে লাল, যেন জ্বলছে!
ঠিক! ওই ব্যাটাকেই খানিক আগে দেখেছি আমি! আবার চেঁচিয়ে উঠল। রবিন।
রত্নদানো। কোন সন্দেহ নেই, সায় দিয়ে বললেন মিস ভারনিয়া।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। গভীর চিন্তায় মগ্ন।
তারপর? হঠাৎ প্রশ্ন করল গোয়েন্দাপ্রধান।
কাপে চুমুক দিলেন মিস ভারনিয়া, অল্প অল্প কাঁপছে তাঁর হাত। আমার দিকে চেয়ে ফুঁসে উঠল দানোটা। গাঁইতি বাগিয়ে শাসাল। তারপর এক ফুয়ে বাতি নিভিয়ে দিল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দড়াম করে বন্ধ হল দরজার পাল্লা। ছুটে গেলাম দরজার কাছে। বন্ধ! বাইরে থেকে আটকে দেয়া হয়েছে। ভাঁড়ারে আটকা পড়লাম আমি!
কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলল মুসা, থেমে গেল। ঘরের দূর প্রান্তে ঝনঝন। শব্দ উঠল। আলোচনায় এতই মগ্ন ছিল ওরা, চমকে উঠল ভীষণভাবে।
০৬.
সর্বনাশ! কণ্ঠস্বরে মনে হল মিস ভারনিয়ার গলা চেপে ধরেছে যেন কেউ। হল কি?…আরে! আমার ছবিটা পড়ে গেছে।
ছুটে গেল তিন গোয়েন্দা। মেঝেতে পড়ে আছে সোনালি ধাতব ফ্রেমে বাঁধাই করা একটা বড়সড় ছবি। ছবিটা চিৎ করল কিশোর। মিস ভারনিয়ার সুন্দর একটা, ছবি, তরুণী ছিলেন তখন তিনি।
আমার বইয়ের ছবি আঁকত যে শিল্পী, বললেন লেখিকা, সে-ই এই ছবিটা এঁকে দিয়েছিল।
ছবিতে ঘাসের ওপর বসে বই পড়ছেন মিস ভারনিয়া, তাকে ঘিরে বসে আছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়ের দল, লেখিকার রত্নদানো, বামন, আর খাটোভূত।
ওপর দিকে তাকাল কিশোর। ছাতের হুক থেকে ঝুলছে একটা সরু শেকল, ওটাতেই ঝোলানো ছিল ছবিটা। কোন কারণে শেকল ছিঁড়ে পড়েছে, ফ্রেমের সঙ্গে লাগানো আছে শেকলের ছেঁড়া একটা অংশ।
ছেঁড়া মাথাটা ভালমত পরীক্ষা করল কিশোর, মুখের ভাব বদলে গেল। মিস ভারনিয়া, শেকলটা ছিঁড়ে পড়েনি। লোহাকাটা করাত দিয়ে কেটে রাখা হয়েছিল। এমনভাবে, যাতে ছবিটা ঝুলে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর বাতাসে বা অন্য কোনভাবে নাড়া লাগলেই খসে পড়ে।
বল কি! রুমাল দিয়ে কপালের ঘাম মুছলেন লেখিকা। রত্নদানো! নিশ্চয় রত্নদানোর কাজ! যে-রাতে—ও, এখনও আসিনি সে-কথায়।
শেকল জোড়া লাগিয়ে আবার ঝুলিয়ে দিচ্ছি ছবিটা। কাজ করতে করতে আপনার কথা শুনব।—ও হ্যাঁ, প্লয়ার্স আছে?
আছে।
কিশোর আর মুসা শেকল জোড়া লাগাতে বসে গেল। মিস ভারনিয়া তাঁর। কাহিনী বলে গেলেন, নোট নিতে থাকল রবিন।
সে-রাতে ভাঁড়ারে আটকা পড়েছিলেন মিস ভারনিয়া। তাঁর ভাইপো এসে দরজার ছিটকিনি খুলে তাকে উদ্ধার করল। ফুফুর কাহিনী মন দিয়ে শুনল বুব, কিন্তু এক বিন্দু বিশ্বাস করল না। অবশেষে আস্তে করে বলল, কোন চোর-টোর ঢুকেছিল বাড়িতে, সেই দরজা আটকে দিয়েছে…