উঠে গিয়ে শেলফ থেকে চামড়ায় বাঁধাই করা মোটা, পুরানো একটা বই নিয়ে এলেন মিস ভারনিয়া। প্রায় দেড়শো বছর আগে জার্মানীতে ছাপা হয়েছিল এ-বই। ছেলেরা ঘিরে বসলে এক এক করে পাতা উল্টাতে শুরু করলেন তিনি। লেখক অনেক দিন বাস করেছেন ব্ল্যাক ফরেস্টে। রত্নদানো, বামন আর খাটোভূতদের নাকি তিনি দেখেছেন। নিজের হাতে ছবি এঁকেছেন ওগুলোর। এই যে, এই ছবিটা দেখ।
পুরো পৃষ্ঠা জুড়ে একটা ড্রইং। কুৎসিত চেহারার একটা মানুষ যেন। মাথায় চূড়া আর বারান্দাওয়ালা চামড়ার টুপি, হাত-পায়ে বড় বড় রোমি। কাঁধে ধরে রেখেছে একটা ছোট গাইতি। লাল চোখ, যেন জ্বলছে। রেগে আছে যেন কোন কারণে।
ঠিক একটা…মানে এই চেহারাই দেখেছি জানালায়! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
লেখক এর নাম দিয়েছেনরত্নদানোর দুষ্ট রাজা! বলে গেলেন মিস ভারনিয়া। কিছু কিছু রত্নদানো আছে, যারা খুবই খারাপ। তবে ভাল রত্নদানোও আছে। যারা খারাপ, লেখকের মতে, তাদের চোখ লাল হয়ে যায়।
খাইছে! বিড়বিড় করল মুসা।
খারাপটাকেই দেখেছি তাহলে! আপনমনেই বলল রবিন। রত্নদানো সত্যিই দেখেছে, এই বিশ্বাস আবার ফিরে আসছে তার।
পাতা উল্টে সাধারণ পোশাক পরা আরও কিছু রত্নদানোর ছবি দেখালেন মিস ভারনিয়া। ঠিক এই ধরনের পোশাক পরা রত্নদানো দেখেছি আমি কয়েকটা, আস্তে বইটা বন্ধ করে রেখে দিলেন তিনি। ছবি তো দেখাই আছে, তাই ব্যাটাদেরকে দেখার সঙ্গে সঙ্গে চিনেছি। যা যা ঘটেছে, সবই বলব। তবে আগে অন্যান্য কথা কিছু বলে নিই। পুরানো দিনের কথা, যখন খোকা-খুকুদের জন্যে আমি লিখতাম। দীর্ঘশ্বাস পড়ল লেখিকার, অতীতের সোমালি দিনগুলোর কথা মনে পড়ে যাওয়াতেই বোধহয়। অল্প বয়েস থেকেই লিখতে শুরু করি আমি। বাবা-মা মারা গেলেন, তখন নামডাক ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে আমার। ভাল পয়সা আসতে শুরু করল। এসব অনেক আগের কথা, তোমাদের জন্মও হয়নি তখন। আমার বাড়ি খুঁজে বের করত বাচ্চারা, আমার সঙ্গে আলাপ করতে আসত, আমার সই নিতে আসত। বাচ্চাদেরকে ভালবাসি আমি, তাই আশপাশের বাড়ির যত বাচ্চা ছিল, সবাই ছিল। আমার বন্ধু। ধীরে ধীরে সময় বদলাল, পরিবেশ বদলাল। পুরো অঞ্চলটা বদলে গেল কি করে, কি করে জানি! পুরানো বাড়িঘর সব ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হল, ভাল ভাল গাছপালা কেটে সাফ করে ফেলা হল, বসত বাড়ির জায়গায় দিনকে দিন। গজিয়ে উঠতে লাগল দোকানপাট। আমার বাচ্চা বন্ধুরা যেন হুড়মুড় করে বড় হয়ে। গেল, কে যে কোথায় চলে গেল তারপর, জানি না। অনেকেই আমাকে এখান থেকে সরে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে, কিন্তু পারলাম না। কিছুতেই এই পরিচিত বাড়িটা বিক্রি করে যেতে পারলাম না। যাবও না। যতদিন বাঁচব, এখানে, এই বাড়িতেই থাকব। এখানে কেন পড়ে আছি, বোঝাতে পেরেছি তোমাদেরকে?
তিনজনেই মাথা নোয়াল একবার।
বদলেই চলেছে সবকিছু, আবার বললেন মিস ভারনিয়া। বেশ কয়েক বছর আগে বন্ধ হয়ে গেছে থিয়েটারটা। ফলে লোক সমাগমও অনেক কমে গেছে, আগের চেয়ে, প্রায় নির্জনই বলা চলে এখন অঞ্চলটাকে। গেটে কার্ড লাগিয়ে দিয়েছি আমি। পুরানো বন্ধুদের কেউ যদি কখনও আসে, শিস দিয়ে আমাকে ডাকবে। এটাই নিয়ম ছিল, এভাবেই ডাকত আমার রত্নদানো, বামন আর খাটোভূতেরা। লেখিকার চোখের কোণ টলমল করছে। জান, এখনও কালেভদ্রে ওদের কেউ না কেউ আসে, শিস দিয়ে ডাকে আমাকে। ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দিই। কিন্তু আগের সেই নিষ্পাপ ফুলগুলোকে আর দেখি না! ওরা আজ অনেক বড়! চুপ করলেন মিস ভারনিয়া। চুপ করে রইল তিন গোয়েন্দা।
যাব না যাব না, বলছি বটে, কিন্তু যাবার দিন হয়ত এসে গেছে আমার, বললেন মিস ভারনিয়া। আমাকে সরে যেতে বাধ্য করবে ওরা। ইতিমধ্যেই কয়েকবার প্রস্তাব নিয়ে এসেছে মিস্টার রবার্ট। আমার জায়গাটা কিনে নিতে পারলে তার সুবিধে হয়। কিন্তু মুখের ওপর মানা করে দিয়েছি। ওরা বুঝতে পারে না, আমি এখানে জন্মেছি, বড় হয়েছি, জীবনের সোনালি দিনগুলো আমার এখানেই কেটেছে, এই জায়গা ছেড়ে আমি কি করে যাই? আমার খাটোভূতদের স্মৃতি যে জড়ানো রয়েছে এর প্রতিটি ইটকাঠে!
মহিলাকে বাড়ি ছাড়া করতে খুব কষ্ট হবে মিস্টার রবার্টের, বুঝতে পারল তিন গোয়েন্দা। আদৌ পারবে কিনা, তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
আরেক কাপ চা ঢেলে নিলেন মিস ভারনিয়া। আমার অতীত নিয়ে বড় বেশি বকবক করে ফেলেছি, না? হয়ত তোমাদের খারাপ লাগছে। কিন্তু কতদিন পর মন খুলে কথা বলার সুযোগ পেয়েছি! উহ, কতদিন! কাপে চুমুক দিলেন তিনি। থাক। এখন ওসব কথা। কাজের কথায় আসি। মাত্র কয়েক রাত আগে, হ্যাঁ, মাত্র কয়েক রাত। রত্নদানোদের দেখেছি আমি। না না, আমার বাচ্চা বন্ধু নয়, সত্যিকারের দানো!
খুলে বলুন, প্লীজ, অনুরোধ করল কিশোর। রবিন, নোট নাও।
পকেট থেকে নোটবই আর পেন্সিল বের করল রবিন।
বয়েস হয়েছে, বললেন মিস ভারনিয়া। কিন্তু ঘুম ভালই হয় আমার এখনও। কয়েক রাত আগে, অদ্ভুত একটা শব্দ শুনে মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। নরম মাটিতে গাঁইতি চালাচ্ছে যেন কেউ, এমনি শব্দ।
মাঝরাত? গাঁইতি? ভুরু কুঁচকে বলল কিশোর।
হ্যাঁ। প্রথমে ভেবেছি, ভুল শুনেছি। রাতদুপুরে মাটি কাটতে আসবে কে? একমাত্র…