লাল চোখওয়ালা রত্নদানো! ইয়াল্লা! গুঙিয়ে উঠল মুসা। রবিন, দোহাই তোমার, বল, ওটা তোমার কল্পনা!
বার বার ছাগলকে কুকুর বলছে ওরা!-নিজের দৃষ্টিশক্তির ওপর সন্দিহান হয়ে উঠল রবিন। তাই তো, বেশিক্ষণ তো দেখিনি ওটাকে। মাত্র এক পলক! কি জানি! গলায় আর আগের জোর নেই তার। মনে তো হল, দেখেছি! কিন্তু-কি জানি, কল্পনাও হতে পারে! তখন অবশ্য এনসাইক্লোপীডিয়ায় দেখা রত্নদানোর ছবির কথা ভাবছিলাম। নাহ্, খুব সম্ভব কল্পনাই করেছি!
কল্পিত জীবকে পাওয়া যাওয়ার কথা না, দ্বিধায় পড়ে গেছে কিশোর। কিন্তু যদি সত্যি দেখে থাক, তাহলে জাদু জানে ব্যাটা! গায়েব হওয়ার মন্ত্র!
এছাড়া বেরোবে কি করে আঙিনা থেকে? যোগ করল মুসা।
চল, ঘরে যাই, বলল কিশোর। মিস ভারনিয়ার কথা শুনিগে। এখানে দাঁড়িয়ে থেকে আর লাভ নেই।
সামনের বারান্দা দিয়ে আবার ঘরে ঢুকল ওরা। হল পেরিয়ে লাইব্রেরিতে এল।
ওকে পাওনি তো? জিজ্ঞেস করলেন লেখিকা।
নাহ, মাথা নাড়ল রবিন। গায়েব!
আমি জানতাম, পাবে না, মাথা দুলিয়ে বললেন মিস ভারনিয়া। রত্নদানোরা ওরকমই, এই আছে এই নেই! তবে আমিও অবাক হয়েছি, দিনের বেলায় আসতে দেখে। দিনের আলোয় সাধারণত বেরোয় না ওরা। যাকগে, এস আগে চা খেয়ে নিই। তারপর বলল, কি কি ঘটেছে।
চীনামাটির কেটলি থেকে কাপে চা ঢালতে ঢালতে বললেন লেখিকা, আশা করি তোমরা আমাকে সাহায্য করতে পারবে। ক্রিস্টোফারের খুব ভাল ধারণা তোমাদের ওপর। কয়েকটা অদ্ভুত রহস্য নাকি ভেদ করেছ।
তা করেছি, সবার আগে কাপ টেনে নিয়ে চায়ে প্রচুর পরিমাণে দুধ আর চিনি। মেশাতে লাগল মুসা। তবে বেশির ভাগ কৃতিত্বই কিশোরের, তাই না, রবিন?
অন্তত আশি পার্সেন্ট, গম্ভীর গলায় বলল নথি। বাকি বিশ পার্সেন্ট আমাদের দুজনের। কিশোর, ঠিক না? এই, কিশোর?।
পাশের একটা কাউচে পড়ে থাকা খবরের কাগজের হেডলাইনে মনোযোগ কিশোরের। রবিনের ডাকে মুখ না ফিরিয়েই বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, মিস ভারনিয়া, রবিন। আর মুসার সাহায্য ছাড়া একটা রহস্য ভেদ করতে পারতাম না।
মিউজিয়মের খবরটা দেখছ মনে হচ্ছে? চা আর বিস্কুট বাড়িয়ে ধরে কিশোরকে বললেন মিস ভারনিয়া। কি যে হয়েছে দিনকাল! চারদিকে খালি গোলমাল আর গোলমাল! রহস্যের ছড়াছড়ি!
একটা বিস্কুট আর কাপটা নিল কিশোর। এক কামড় বিস্কুট ভেঙে চিবিয়ে চা দিয়ে গিলে নিল। গোল্ডেন বেল্টটা যখন চুরি হয়, তখন মিউজিয়মেই ছিলাম। আমরা, সে এক তাজ্জব কাণ্ড! সাহায্য করতে চেয়েছিলাম, কিন্তু রাজি হলেন না সিকিউরিটি ইনচার্জ। আমরা নাকি বড় বেশি ছেলেমানুষ।
ভাগিয়ে দিলেন, সেকথা বলছ না কেন? একসঙ্গে দুটো বিস্কুট মুখে পুরেছে মুসা, কথা অস্পষ্ট।
আরে, এ কি! মুসার দিকে চেয়ে বলে উঠল কিশোর। এই না একটু আগে হাঁসফাস করছিলে বেশি খেয়ে ফেলেছিলে বলে?
ও হ্যাঁ, তাই তো! কিশোর মনে করিয়ে দেয়ায় যেন মনে পড়ল মুসার। পেটে হাত রাখল। প্লেট থেকে বড় আকারের আরও গোটা চারেক বিস্কুট একসঙ্গে তুলে নিয়ে বলল, এই কটাই, ব্যস, আর খাব না। আরে, এত উত্তেজনা, পেটের কথা মনে থাকে নাকি?
মুচকি হাসল কিশোর।
আরে থাক, থাক, বললেন মিস ভারনিয়া। ছেলেমানুষ, এই তো তোমাদের খাওয়ার বয়েস।—হ্যাঁ, যা বলছিলাম। ইনচার্জ তোমাদেরকে ভাগিয়ে দিয়ে উচিত। করেনি। তবে আমার জন্যে ভালই হল। তোমরা অন্যখানে ব্যস্ত থাকলে আমার এখানে আসতে পারতে না। খাও, চা-টা আগে শেষ কর, তারপর কথা হবে।
মিস ভারনিয়ার ভরসা পেয়ে পুরো প্লেট খালি করে দিল মুসা। আরেক কাপ চা নিয়ে আবার দুধ আর চিনি মেশাতে শুরু করল।
পুরানো দিনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে! বললেন লেখিকা। আহা, কি সব দিনই না ছিল। কতদিন পর আবার ছেলেদের সঙ্গে বসে চা খাচ্ছি! পুরো একটা হপ্তাও পেরোত না, টি-পার্টি দিতাম, রত্নদানো, বামন আর খাটোভূতদের নিয়ে।
বিষম খেল মুসা। গলায় চা আটকে যাওয়ায় কাশতে শুরু করল। বিস্কুটে কামড় বসিয়ে মাঝপথেই থেমে গেল রবিন।
শুধু কিশোরের অবস্থা স্বাভাবিক রইল। শান্ত কণ্ঠে বলল, প্রতিবেশী বাচ্চাদের দাওয়াত করতেন, না? ওদের নামই দিয়েছেন রত্নদানো, বামন আর খাটোভূত?
নিশ্চয়। হাসি ফুটল লেখিকার মুখে। খুব চালাক ছেলে তো তুমি! কি করে। বুঝলে?
ডিডাকশন, খালি কাপটা টিপয়ে নামিয়ে রাখল কিশোর। দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো দেখিয়ে বলল, সব বাচ্চাদের ছবি। পোশাক-আশাক পুরানো ছাঁটের, এখন আর ওসব ডিজাইন কেউ পরে না। কোন কোন ছবির নিচে লেখা দেখলাম: প্রিয় মিস ভারনিয়াকে। আপনি একজন লেখিকা, কল্পিত জীব নিয়ে অনেক বই লিখেছেন, সবই বাচ্চাদের জন্যে। দুটো বই পড়েছি আমি। দারুণ বই। রত্নদানো আর খাটোভূতের চরিত্রগুলো সব মানুষের বাচ্চার মত। ধরেই নিলাম, আদর করে আপনার বাচ্চা বন্ধুদেরকে ওসব নামে ডাকেন। হাঁ হয়ে গেছে রবিন আর মুসা। ওই দুটো বই ওরাও পড়েছে, দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলোও দেখেছে। কিন্তু কিশোরের মত ভেবেও দেখেনি, গুরুত্বও দেয়নি।
ঠিক, ঠিক বলেছ। আনন্দে বাচ্চা মেয়ের মত হাততালি দিয়ে উঠলেন মিস ভারনিয়া। তবে একটা ব্যাপার ভুল বলেছ। বামন কিংবা খাটোভূত কল্পিত হতে পারে, কিন্তু রত্নদানোরা নয়। ওরা বাস্তব। আমি শিওর। একটু থেমে বললেন, আমার বাবার যথেষ্ট টাকা-পয়সা ছিল। আমি যখন বাচ্চা ছিলাম, আমার জন্যে একজন গভর্নেস রেখে দিয়েছিলেন বাবা। কি সব সুন্দর সুন্দর গল্প যে জানত মহিলা! আমাকে শোনাত। ব্ল্যাক ফরেস্টে রত্নদানো আর বামনেরা বাস করে, ওই মহিলাই প্রথম বলেছে আমাকে। বড় হয়ে তার মুখে শোনা অনেক গল্প নিজের মত করে লিখেছি। একটা বই উপহার দিয়েছিল আমাকে মহিলা। বইটা জার্মান ভাষায় লেখা। হয়ত বুঝবে না তোমরা, কিন্তু ছবি বুঝতে কোন অসুবিধে নেই। নিয়ে। আসছি বইটা।