চোখ বড় বড় হয়ে গেছে দুই গোয়েন্দার। হুপারের কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম।
বাড়ির প্রান্তে পৌঁছে গেছে কিশোর, হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে ডাকল, কি হল তোমাদের? এস।
দ্রুত এগিয়ে গেল রবিন আর মুসা। গোয়েন্দাপ্রধানের সঙ্গে সঙ্গে এগোল।
বিশাল জানালা দিয়ে জাদুঘরে ঢুকে পড়ল ওরা। কফিনটার সামনে গিয়ে। দাঁড়ালেন প্রফেসর। ঢাকনা তুলে দাঁড় করিয়ে রাখলেন পাশে। বললেন, এই যে, রা-অরকনের মমি। ও কি বলার চেষ্টা করেছে, আশা করি জানতে পারবে তোমরা। বলতে পারবে আমাকে।
গভীর প্রশান্তিতে যেন কফিনের ভেতর ঘুমিয়ে রয়েছে মেহগনি রঙের মমিটা। চোখের পাতা বোজা, কিন্তু দেখে মনে হয় যে-কোন মুহূর্তে মেলবে।
মমিটার ওপর তীক্ষ্ণ নজর বোলাল কিশোর। চোখেমুখে কৌতূহল।
রবিন আর মুসাও দেখছে, তবে কৌতূহলী বা আগ্রহী মনে হচ্ছে না তাদের। বরং শঙ্কা ফুটেছে চেহারায়। চাওয়া-চাওয়ি করল দুই সহকারী গোয়েন্দা।
ইয়াল্লা! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল মুসা। একেবারে জ্যান্ত! ড্রাকুলা জাতীয় কোন ভূত! কিশোর, এবার সত্যি সত্যি ভূতের পাল্লায় পড়ব!
.
০৫.
গভীর মনোযোগে মমিটাকে পর্যবেক্ষণ করছে কিশোর। পাশে দাঁড়িয়ে রুমাল দিয়ে বার বার কপালের ঘাম মুছলেন প্রফেসর।
হুপার, খানসামাকে দেখেই বলে উঠলেন প্রফেসর, সবগুলো জানালা খোল! বলেছি না, আমি বন্ধ ঘর একেবারে সইতে পারি না।
এই যে, স্যার, দিচ্ছি, তাড়াহুড়ো করে একটা জানালার দিকে এগিয়ে গেল। লম্বা লোকটা। খুলে দিল জানালা। এক ঝলক বাতাস এসে ঢুকল ঘরে। দেয়ালে, ঝোলানো মুখোশগুলোকে নাড়িয়ে দিল। অদ্ভুত একটা খসখস আর টুংটাং আওয়াজ উঠল চারপাশ থেকে।
শব্দ শুনে মুখ তুলল কিশোর। প্রফেসর, ওই শব্দ শোনেননি তো? বাতাসে মুখোশ কিংবা আর কিছু নড়ানর শব্দ?
না না, মাথা নাড়লেন প্রফেসর। মানুষের কণ্ঠস্বর চিনতে পারি না ভাবছ? মমিটাই কথা বলেছিল!
তাহলে, বলল কিশোর, ধরে নিচ্ছি, আপনি সত্যিই মমিকে কথা বলতে শুনেছেন, এবং সম্ভবত প্রাচীন আরবীতে, তাই না?
এখানে কি আর কিছু করার আছে, স্যার, আমার? মাঝখান থেকে বলে উঠল হুপার। অনেক কাজ পড়ে আছে। যাব?
সবকটা চোখ ঘুরে গেছে খানসামার দিকে। হঠাৎই তার চোখ বড় বড় হয়ে উঠতে দেখল সবাই। শঙ্কিত। প্রফেসরকে লক্ষ্য করে ঝাঁপ দিল হুপার। তাঁকে নিয়ে গড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। পরমুহূর্তেই দুম করে পড়ল কাঠের ভারি মূর্তিটা। শেয়ালমাথা দেবতা আনুবিস। মুহূর্ত আগে প্রফেসর যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঠিক সেখানে। পাশে কাত হয়ে গেল মূর্তি, মুখ প্রফেসরের দিকে। তাঁকে শাসাচ্ছে যেন। নীরবে।
কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়ালেন প্রফেসর।
হুপারও উঠল। সে আরও বেশি কাঁপছে। আমি…আমি ওটাকে নড়ে উঠতে দেখেছিলাম, স্যার! গলা কাঁপছে। ভর্তা হয়ে যেতেন এতক্ষণে। ঢোক গিলল খানসামা। রা-অরকনের অভিশাপ, আর কিছু না! মমিটার সঙ্গে সঙ্গে এসে হাজির হয়েছে।
আরে দূর! হাত দিয়ে ঝেড়ে হাতের ধুলো পরিষ্কার করছেন প্রফেসর। যত্তোসব কুসংস্কার! আর ওই খবরের কাগজওয়ালারা হয়েছে একেকটা গপ্পোবাজ। কিছু একটা পেলেই হল। রঙ চড়িয়ে সাতখান করে বাড়িয়ে লিখে খালি কাগজ বিক্রির ফন্দি। এমন ঘটনা আরও ঘটেছে তুতানখামেনের মমি আবিষ্কার করার পর। অনেকেই মরল, অথচ কি সুন্দর বেঁচে গেলেন হাওয়ার্ড কার্টার। নাটের গুরু তিনি, অভিশাপে মরলে তারই সবার আগে মরার কথা ছিল। তার তো স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে। ওসব আবোল-তাবোল কথা বিশ্বাস করার কোন কারণ নেই। মূর্তিটা পড়েছে অন্য কোন কারণে, অভিশাপের জন্য নয়। হয়ত ঠিকমত দাঁড় করানো হয়নি। বাতাসে পড়ে গেছে।
স্যার, ভুলে যাচ্ছেন, খসখসে শোনল হুপারের কণ্ঠ। তিন হাজার বছর ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে ছিল মূর্তিটা, পড়েনি। আজ হঠাৎ করে পড়তে গেল কেন? আপনি ভর্তা হয়ে মরতেন, লর্ড কার্নারভনের—-
লর্ড কার্নারভন অসুখে মরেছিলেন, তপ্তকণ্ঠে বললেন প্রফেসর। মূর্তি পড়ে ভর্তা হননি। যাও, ভাগ এখন।
যাচ্ছি, স্যার, ঘুরে দাঁড়াল হুপার।
ঝুকে মূর্তিটা দেখছিল কিশোর, মাথা তুলল। থামাল খানসামাকে। হুপার, আপনি বললেন মূর্তিটাকে নড়ে উঠতে দেখেছেন। কিভাবে কোনদিকে নড়েছিল?
নাক বরাবর সামনের দিকে পড়তে লাগল, মাস্টার পাশা, টলে উঠেছিল। প্রথমে, জবাব দিল হুপার। আজ দাঁড়ানর ভঙ্গিতেই কেমন গোলমাল ছিল, খেয়াল করেছি! সামান্য নাড়া লাগলেই পড়ে যাবে, এমন ভঙ্গি। যেন আগেভাগেই প্ল্যান। করে রেখেছিল, আজ প্রফেসর সাহেবের ওপর পড়বে!
হুপার! তীক্ষ্ণ শোনাল প্রফেসরের কণ্ঠ।
সত্যিই বলছি, স্যার। টলে উঠল আনুবিস, সামনে ঝুঁকে পড়ে গেল। সময়মত নড়তে পেরেছিলাম, তাই রক্ষে!
হ্যাঁ, খুব ভাল করেছ। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ, তিক্ত কণ্ঠে বললেন, প্রফেসর। সব বাজে কথা! অভিশাপ-
একটা ধাতব মুখোশ খসে পড়ে তীক্ষ্ণ ঝনঝন শব্দ তুলল। প্রায় লাফিয়ে উঠল ঘরের সবাই। চমকে ফিরে তাকাল ওরা।
দেখলেন!–দেখলেন তো, স্যার! আতঙ্কে ছিটকে বেরিয়ে আসবে যেন হুপারের চোখ।
বাতাস! গলায় আর তেমন জোর নেই প্রফেসরের। বাতাসই ফেলেছে। আনুবিসকে, মুখোশটাও ফেলল।
হাঁটু গেড়ে কাঠের মূর্তিটার পাশে বসে পড়েছে কিশোর। হাত বোলাচ্ছে তলার চারকোনা জায়গাটায়-যার ওপর ভিত্তি করে দাঁড়িয়েছিল মূর্তি। যথেষ্ট ভারি মূর্তি, স্যার, মুখ না তুলেই বলল কিশোর। তলাটাও খুব মসৃণ। সহজে নড়ার কথা নয়। এই মূর্তি বাতাসে ফেলতে হলে ঝড়ো বাতাস দরকার।