ভেব না, আশ্বাস দিল কিশোর। শিগগিরই আবার ওটাতে চড়ব আমরা।
কি করে! মুসা অবাক। তিরিশ দিন তো সেই কবেই পেরিয়ে গেছে!
দুইয়ে দুইয়ে চার হলেও, তিরিশ দিনে অনেক সময় তিরিশ হয় না, রহস্যময় কণ্ঠে বলল কিশোর। আমি বলে রাখছি, ওই গাড়িটা আবার ব্যবহার করব আমরা। মাসখানেকের জন্যে ভাড়া নিয়েছেন এক ব্যাংকার। মেয়াদ শেষ হলেই কোম্পানির অফিসে ফিরে আসবে গাড়িটা। তখন ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করে বললেই…
দিয়ে দেবে! ফস করে বলে উঠল মুসা। এতই সহজ!
একই কথা বলেছিলে মিস্টার ক্রিস্টোফারের সঙ্গে প্রথম দেখা করতে যাওয়ার আগে। যাকগে, কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। আমরা বোধহয় এসে গেছি।
আঁকাবাঁকা গিরিপথে পাহাড়ের ঢাল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল গাড়ি। খানিক দূরেই বাড়িটা। পুরানো ধাঁচের পোর্টিকো, বিশাল সব থাম। একটা থামে বসানো পেতলের প্লেটে খোদাই করা রয়েছে প্রফেসর হার্বার্ট বেনজামিনের নাম। গাছপালা ঝোঁপঝাড় ঘিরে রেখেছে লাল টালির ছাত দেয়া স্প্যানিশ ধাচের বাড়িটাকে। একপাশে গোল হয়ে নেমে গেছে পাহাড়, সরু উপত্যকা সৃষ্টি করে ওপাশে আবার উঠে গেছে আরেকটা পাহাড়ের সঙ্গে যুক্ত হয়ে। ওই পাহাড়টার ঢালে বিভিন্ন সমতলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে উঠেছে কয়েকটা বাড়ি। নতুন। বাংলো টাইপ।
চল নামি, বন্ধুদেরকে বলল কিশোর। দরজা খুলে নেমে পড়ল ট্যাক্সি থেকে।
রবিন আর মুসাও নামল। ড্রাইভারকে অপেক্ষা করতে বলল কিশোর।–
কিশোর, আমার ভয় করছে! বলে উঠল মুসা। প্রফেসর বেনজামিন পাগল টাগল নয় তো? বুড়ো ওই বিজ্ঞানীগুলো সাধারণত পাগলাটে হয়! বদমেজাজীও!
নাহ, জোর দিয়ে বলল কিশোর। আসার আগে তো টেলিফোন করলাম। গলা শুনে খুব ভদ্র বলেই মনে হল। চল, আমাদের জন্যে অপেক্ষা করছেন। ভদ্রলোক।
পাগলা না হলেই ভাল! বিড়বিড় করল মুসা। এগোল গোয়েন্দাপ্রধানের পিছু পিছু। আর হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। মমির কথা শুনলে আমিও পাগল হয়ে যাব…
.
প্রফেসর বেনজামিন উত্তেজিত। চত্বরে ইজি চেয়ারে বসে আছেন পিঠ সোজা করে। সামনে টেবিলে কফির কাপ। পাশে দাঁড়িয়ে আছে খানসামা।
হুপার, বললেন প্রফেসর। সত্যি শুনেছ তো?
মনে তো হল, স্যার, জবাব দিল খানসামা। দাঁড়িয়ে ছিলাম ঘরটায়। অন্ধকার। হঠাৎ মৃদু একটা শব্দ-কথা বলার আওয়াজই হবে, শুনলাম!
তারপর?
আমার মনে হয়, ইঁদুর-টিদুর, স্যার, প্রফেসরের প্রশ্ন এড়িয়ে গেল হুপার। শূন্য কাপটা তুলে নিল টেবিল থেকে। ন্যাপকিন এগিয়ে দিল।
ঠোঁট মুছলেন প্রফেসর। কিছু একটা হয়েছে আমার, হুপার! হঠাৎ গতরাতে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। দুরুদুরু করছিল বুকের ভেতর। কেন, কে জানে! হয়ত—হয়ত রহস্যটা আমার স্নায়ু দুর্বল করে দিয়েছে।
আমারও খুব অস্বস্তি লাগছে, স্যার, বলল হুপার। আপনার কি মনে হয়… থেমে গেল কথা শেষ না করেই।
মনে হয় কি মনে হয়? বল?
ইয়ে—মানে—বলছিলাম কি, ব্র-অরকনকে আবার মিশরে পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? কায়রোর সেই জাদুঘরে? বেচে যেতেন
না! দৃঢ় কণ্ঠে বললেন প্রফেসর। মাঝপথেই হাল ছেড়ে দেয়া আমার স্বভাব নয়। তাছাড়া সাহায্য আসছে।
গোয়েন্দার কথা বলছেন তো, স্যার? ওদেরকে বলা উচিত হবে না। পুলিশের কানে কথাটা যাওয়া কি ঠিক?
পুলিশের কানে যাবে না। আমার বন্ধু, ডেভিস কথা দিয়েছে। দাম আছে তার কথার— কলিং বেলের সুরেলা শব্দে থেমে গেলেন প্রফেসর, ওই যে, এসে গেছে ওরা। হুপার, জলদি যাও। নিয়ে এস ওদেরকে এখানে।
যাচ্ছি, স্যার, তাড়াহুড়ো করে চলে গেল খানসামা। একটু পরেই তিন গোয়েন্দাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এল।
ভুরু কুঁচকে বসে আছেন প্রফেসর। সেটা লক্ষ্য করল কিশোর। বুঝলে তিনটে কিশোরকে আশা করেননি তিনি। ভারিক্কি চালে পকেট থেকে কার্ড বের করে বাড়িয়ে কার্ডটা দিল সে।
যন্ত্রচালিতের মত হাত বাড়িয়ে কার্ডটা নিলেন প্রফেসর। চোখ নামালেন কার্ডের দিকে। ছাপা রয়েছে:
???
তিন গোয়েন্দা।
প্রধান: কিশোর পাশা
সহকারী: মুসা আমান।
নথিরক্ষক ও গবেষক: রবিন মিলফোর্ড
আর সবাই যা করে, সেই একই প্রশ্ন করলেন প্রফেসর বেনজামিনওঃ প্রশ্নবোধকগুলো কেন?
জানাল কিশোর ওগুলো রহস্যের প্রতীকচিহ্ন।
হমম্! কার্ডটা হাতে নিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে ওল্টাচ্ছেন-পাল্টাচ্ছেন প্রফেসর। ডেভিস পাঠিয়েছে তোমাদেরকে। ওর ওপর আমার অগাধ বিশ্বাস, কাজেই তোমাদের ওপর ভরসা রাখছি আপাতত। পুলিশকে ডেকে পাঠাতে পারতাম, কিন্তু, অসুবিধা আছে। ওরা আমার কথা বিশ্বাস করবে না। জোরজার করি যদি বেশি, একজন ডিটেকটিভ পাঠাবে। লোকের নজরে পড়বেই ব্যাপারটা।খোঁজখবর শুরু করবে ওরা। আসল খবরটা ঠিক বের করে নেবে। পাগল খেতাব দিয়ে বসবে আমাকে।
উঠলেন প্রফেসর। এস, রা-অরকনকে দেখাব, বলেই হাঁটতে শুরু করলেন বা প্রান্তের দিকে।
প্রফেসরকে অনুসরণ করল কিশোর। রবিন আর মুসাও পা বাড়াতে যাচ্ছিল, একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে তাদেরকে ঠেকাল হুপার। হাতটা কাঁপছে। চেহারা ফ্যাকাসে, উত্তেজিত ভাবভঙ্গি।
অনেকখানি এগিয়ে গেছেন প্রফেসর আর কিশোর। সেদিক থেকে চোখ ফেরাল হুপার। ফিসফিস করে বলল, ছেলেরা, মমিটা নিয়ে কাজ শুরু করার আগে কিছু কথা জানা দরকার তোমাদের।
কি কথা? ভ্রুকুটি করল মুসা।
একটা অভিশাপ রয়েছে, কণ্ঠস্বর আরও খাদে নামাল হুপার। রা-অরকনের কবরে কিছু মাটির ফলক পাওয়া গেছে। তাতে অভিশাপ বাণী লেখা: যে এই কবরের গোপনীয়তা নষ্ট করবে তার ওপর নামবে রা-অরকনের অভিশাপ। অনেক বছর আগে পাওয়া গেছে মমিটা। উদ্ধার অভিযানে যারা ছিল তাদের অনেকেরই অস্বাভাবিক মৃত্যু ঘটেছে। কারও কারও মৃত্য ছিল ভয়ঙ্কর আকস্মিক। প্রফেসর বেনজামিনও জানেন ব্যাপারটা। কিন্তু বিশ্বাস করেন না, বলেন মমিটা না পেলেও ঘটত ওই মৃত্যু। বৈজ্ঞানিক কোন ব্যাখ্যা নেই এর। কুসংস্কার। এতদিন এড়িয়েই ছিলেন, কিন্তু মমিটা ঘরে আনার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল গণ্ডগোল। ফিসফিস করে নাকি কথা বলে ওটা! তারমানে মাথার গোলমাল শুরু হয়ে গেছে প্রফেসরের। কোনদিন আত্মহত্যা করে বসবেন, কে জানে! তোমরা ব্যাপারটা অনুসন্ধান করে দেখতে চাইছ, দেখ, বাধা দেব না। তবে খুব সাবধান!