উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন প্রফেসর। ভাষাটা বোধহয় আরবী, তবে অনেক প্রাচীন। দুয়েকটা শব্দ কেমন পরিচিত লাগছে না!
বলে যান, রা-অরকন! অনুরোধ জানালেন প্রফেসর। বোঝার চেষ্টা করছি। আমি।
স্যার?
বোমা ফাটাল যেন ডাকটা! চমকে উঠে পাঁই করে ঘুরলেন প্রফেসর। এতই মগ্ন। ছিলেন, হুপার এসে ঢুকেছে, টেরই পাননি। নীরব হয়ে গেছে রা-অরকন।
করাতটা মালিকের দিকে বাড়িয়ে দিল হুপার।
হুপার! উত্তেজনায় চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর। আবার কথা বলেছে মমি! তুমি বেরিয়ে যাওয়ার পর পরই শুরু করেছে! যেই ঘরে ঢুকেছ, থেমে গেছে!
হঠাৎ বড় বেশি গম্ভীর হয়ে গেল হুপার। ভ্রুকুটি করল। তার মানে, আপনি একা না হলে ওটা কথা বলে না! কি বলল, বুঝতে পেরেছেন, স্যার?
না! প্রায় গুঙিয়ে উঠলেন প্রফেসর। ইসস, কেন যে ভাষাবিদ হলাম না! প্রাচীন আরবীই বলছে বোধহয়। হিব্রাইট কিংবা শ্যালডিনও হতে পারে!
ভারি ভারি সব শব্দ! উচ্চারণ করতেই কষ্ট হয় হুপারের, মানে বোঝা তো দূরের কথা। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল সে। চোখে পড়ছে গিরিপথের ওপারে প্রায় একশো গজ দূরে ঢালের গায়ে আরেকটা বাড়ি। নতুন তৈরি হয়েছে, আধুনিক ধাচ।
এত ভাবনার কি আছে, স্যার? হাত তুলে বাড়িটা দেখাল হুপার। প্রফেসর উইলসন তো কাছেই থাকেন। তাকে ডেকে নিয়ে আসুন। রা-অরকনের কথা তিনি বুঝতে পারবেন। অবশ্য যদি তাঁর সামনে কথা বলে মমিটা।
ঠিক, ঠিক বলেছ! চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর। আরও আগেই ডাকা উচিত ছিল জিমকে। জান না বোধহয়, রা-অরকনকে খোঁজার সময় ওর বাবা ছিল আমার সঙ্গে। আহা, বেচারা! মমিটা খুঁজে পাওয়ার এক হপ্তা পরেই নৃশংসভাবে খুন করা হল তাঁকে! কে, কেন করল, কিছু জানা যায়নি!…যাকগে, তুমি এখনি ফোন কর। জিমকে। বল, আমি ডাকছি। এখুনি যেন চলে আসে।
যাচ্ছি, স্যার।
হুপার বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আবার কথা বলে উঠল মমি। শুরু হয়ে গেল তার গা ছমছম-করা ফিসফিসানি।
মমির ঠোঁটের কাছে কান নিয়ে গিয়ে কথা বোঝার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন আরেকবার প্রফেসর। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে সোজা হলেন। তাকালেন গিরিপথের। ওপারের বাড়িটার দিকে। গিরিখাতগুলো এখানে অদ্ভুত। পথের অনেক নিচে নেমে গেছে ওপাশে পাহাড়ের ঢাল। ভাষাবিদ জিম উইলসনের বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে পথের সমতলের বেশ অনেকখানি নিচে।
দেখতে পাচ্ছেন প্রফেসর, বাড়ির একপাশের দরজা দিয়ে বেরোলেন ভাষাবিদ। সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন গ্যারেজে। গাড়ি বেরোল। ছোট্ট একটা বিজ পেরিয়ে নামল পেঁচানো সরু গিরিপথে। চোখ যেদিকেই থাক, প্রফেসরের কান রয়েছে মমির দিকে। ফিসফিস থামিয়ে দিয়েছে ওটা, বোধহয় কথা বোঝাতে ব্যর্থ হয়েই হাল। ছেড়ে দিয়েছে।
হঠাৎ অস্বস্তি বোধ করতে লাগলেন প্রফেসর। যদি কথা না বলে মমিটা? প্রফেসর উইলসন এসেও কিছু করতে পারবেন না। কথা না শুনলে মানে বলবেন কি করে?
কথা থামাবেন না, রা-অরকন! প্লীজ! অনুরোধ করলেন প্রফেসর বেনজামিন। প্লীজ, আবার বলুন! আমি শুনছি। বোঝার চেষ্টা করছি।
নীরব হল মমি। বাইরে গাড়ির ইঞ্জিনের শব্দ হল। খানিক পরেই খুলে গেল। দরজা। ঘরে এসে ঢুকলেন জিম উইলসন।
এই যে, জিম, এসে পড়েছ, বলে উঠলেন প্রফেসর।
হ্যাঁ, কি হয়েছে? জিজ্ঞেস করলেন উইলসন।
এদিকে এস। অদ্ভুত একটা ভাষা শুনতে পাবে!
পাশে এসে দাঁড়ালেন উইলসন। চেঁচিয়ে বললেন প্রফেসর, রা-অরকন, প্লীজ! কথা বলুন, যা বলছিলেন এতক্ষণ, আবার বলুন!
নীরব রইল মমি, এ-ঘরে আসার আগের তিনশো শতাব্দী যেমন ছিল।
কাকে কি বলছেন বুঝতে পারছি না! উইলসনের কণ্ঠে বিস্ময়। হালকা পাতলা শরীর, মাঝারি উচ্চতা, হাসি-খুশি সুন্দর চেহারা। বয়স, এই পঁয়তাল্লিশ ছেচল্লিশ। ভারি চমৎকার কণ্ঠস্বর। ওই শুকনো লাশকে কথা বলতে বলছেন নাকি!
হ্যাঁ, কণ্ঠস্বর খাদে নামালেন প্রফেসর। ফিসফিস করে কথা বলে। অদ্ভুত ভাষায়। শুধু আমার সঙ্গে। অন্য কাউকে ঘরে ঢুকতে দেখলেই—। ভাষাবিদের চাহনি দেখে থেমে গেলেন তিনি। তোমার বিশ্বাস হচ্ছে না, না? রা-অরকন আমার সঙ্গে কথা বলে, বিশ্বাস করতে পারছ না?
গাল চুলকালেন উইলসন। বিশ্বাস করা কঠিন। তবে নিজের কানে শুনলে…
চেষ্টা করে দেখি, মমির ওপর কুঁকলেন প্রফেসর। রা-অরকন, কথা বলুন। বোঝার চেষ্টা করব আমরা।
দুজনেই অপেক্ষা করে রইলেন। রা-অরকনের মমি নীরব।
কোন লাভ নেই, শব্দ করে শ্বাস ফেললেন প্রফেসর। তবে, কথা বলেছিল। ও। বিশ্বাস কর। আবার হয়ত আমি একা হলেই বলবে। তোমাকে শোনাতে পারলে ভাল হত। কি বলছে বুঝতে পারতে।
ভাবভঙ্গিতেই বোঝা যাচ্ছে প্রফেসরের কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না উইলসন। হ্যাঁ, তা হয়ত পারতাম।–আপনার হাতে ওটা কি? করাত—মমিটা কেটে ফেলবেন নাকি?
না, না, মাথা নাড়লেন প্রফেসর। কফিনের কোণ থেকে সামান্য কাঠ নিয়ে কার্বন টেস্টের জন্যে পাঠাব। রা-অরকনকে কবে কবর দেয়া হয়েছিল জানা যাবে।
মূল্যবান জিনিসটা কেটে নষ্ট করবেন! ভুরু কোঁচকালেন উইলসন। তার কি দরকার আছে?
এই মমি আর কফিন সত্যিই মূল্যবান কিনা, এখনও জানি না। জানতে হলে কার্বন টেস্ট করতে হবে। তবে, অদ্ভুত রহস্যটার সমাধান করব আগে। কি বলে, জানব। তার আগে পাঠাচ্ছি না। সত্যি, জিম, খুব অবাক হয়েছি! মমি কথা বলে! তা-ও আবার একা আমার সঙ্গে।