ঢাকনাসুদ্ধ কিশোরকে ঠেলে ফেলে দেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে লোকটা। একবার ফাঁক হয়ে যাচ্ছে ঢাকনা, চেপে আবার নামিয়ে দিচ্ছে কিশোর। ঘামছে দরদর করে। খুব বেশিক্ষণ এভাবে আটকে রাখতে পারবে না, বুঝতে পারছে। ছুটে গিয়ে দরজা তুলতে সময় লেগে যাবে। ততক্ষণে বেরিয়ে এসে তাকে ধরে ফেলবে লোকটা। বাইরে নিশ্চয় পাহারায় রয়েছে দুই চোর। ওরাও মক্কেলের সাহায্যে ছুটে আসবে। সুতরাং ঢাকনায় চেপে বসে থাকা ছাড়া আর কিছুই করার নেই তার। তবে সেটাও নিরাপদ নয়। দশ মিনিট পর এসে কফিনটা নিয়ে যেতে বলা হয়েছে। আসবে মেথু আর ওয়েব। তারমানে, খামোকাই কষ্ট করছে কিশোর। ঠেকাতে পারবে না ওদেরকে শেষ অবধি।
.
১৭.
হঠাৎ বাইরে শোনা গেল অনেক মানুষের গলা। চিৎকার। হুশিয়ারি। গাড়ির হর্নের শব্দ। আরও চেঁচামেচি। ধুপধাপ শব্দ। মারামারি করছে যেন কারা!
বাইরের দিকে খেয়াল করতে গিয়ে মুহূর্তের জন্যে অসতর্ক হয়ে পড়ল। কিশোর। এই সুযোগে এক জোর ধাক্কায় ঢাকনাসহ কাত করে প্রায় ফেলেই দিয়েছিল তাকে লোকটা। তাড়াতাড়ি সামলে নিল কিশোর। চাপ বাড়াল আবার ঢাকনাটায়। ঠিক এই সময় ঘট-ঘটাং আওয়াজ তুলে উঠে গেল দরজা।
কে ওখানে! অন্ধকারে শোনা, একটা পরিচিত কণ্ঠ। আলোর সুইচ খুঁজে পেল লোকটা। জ্বলে উঠল আলো। দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী ব্যাভারিয়ান। রোভার।
হঠাৎ করেই কফিনের তলায় ঠেলাঠেলি থামিয়ে দিয়েছে বন্দী। মিটমিট করে দরজার দিকে তাকাচ্ছে কিশোর। রোভারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে মুসা, রবিন, জামান, প্রফেসর বেনজামিন আর জলিল। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে সবাই তার দিকে।
অবশেষে কথা ফুটল রোভারের, কিশোর, তুমি হোকে?
হোকে, মাথা নাড়াল কিলোর। তার কথার ধরনে হেসে ফেলল সবাই, এমনকি রোভারও। জিজ্ঞেস করল কিশোর, তোমরা এলে কি করে? চোর দুটো কোথায়?
জবাবটা দিল রবিন। তোমাদের ট্রাকটাকে হারিয়ে ফেললাম… তার কথা শেষ হওয়ার আগেই প্রচণ্ড ঠেলা লাগল কফিনের ঢাকনায়। প্রায় পড়ে যেতে যেতে আবার সামলে নিল কিশোর। বিস্মিত চোখে কফিনের দিকে চেয়ে বলল রবিন, ভেতরে কি!
হ্যাঁ, কি? রবিনের কথার প্রতিধ্বনি করলেন যেন প্রফেসর। গোল্ড-রিম চশমার কাঁচের ওপাশে গোল গোল হয়ে উঠছে তার চোখ।
হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে কপালের ঘাম মুছল কিশোর। নাটের গুরু। দুই মাস আগে যে এই খেল শুরু করেছিল। সেই জ্যোতিষ, যে গিয়েছিল লিবিয়ায় জামানদের বাড়িতে। বিশ্বাস করিয়েছিল, রা-অরকন তাদের পূর্বপুরুষ। মমিসহ কফিনটা চুরির প্রেরণা জুগিয়েছে জামান আর জলিলকে।
জ্যোতিষ! সেই জ্যোতিষ! চেঁচিয়ে উঠল জামান। কি বলছ, কিছুই বুঝতে পারছি না!
অসম্ভব! জলিলও চেঁচিয়ে উঠল। এ হতেই পারে না! ওই জ্যোতিষ রয়ে/ গেছে লিবিয়ায়!
নিজের চোখেই দেখতে পাবেন কোথায় রয়ে গেছে, জলিলের দিকে চেয়ে বলল কিশোর। পালানর চেষ্টা করলে রুখবেন আপনাদের জ্যোতিষকে।
আস্তে করে ঢাকনার ওপর থেকে নেমে এল কিশোর। সঙ্গে সঙ্গে ঝটকা দিয়ে খুলে গেল ডালা, কাত হয়ে পড়ল একপাশে। প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল লোকটা। চেহারা ফেকাসে। চোখে শূন্য দৃষ্টি।
জ্যোতিষ! চেঁচিয়ে উঠল জামান। ও জ্যোতিষ নয়। সে লোকটা বুড়ো ছিল! চুলদাড়ি সব সাদা! এক চোখ কানা! কুঁজো! এ তো রীতিমত জোয়ান!
ছদ্মবেশে গিয়েছিল তোমাদের বাড়িতে, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর।
হাঁ হয়ে গেছেন যেন প্রফেসর, মুসা আর রবিন। বোকার মত চেয়ে আছে কফিনে দাঁড়ানো লোকটার দিকে।
উইলসন! বিড়বিড় করলেন অবশেষে প্রফেসর।
হ্যাঁ, উইলসন, জবাব দিল কিশোর। জামানদের প্রিয় জ্যোতিষ। মিসেস চ্যানেলের বেড়ালচোর। মমিচোর! কফিনচোর।
ও চোর! উইলসন চোর! বিশ্বাস করতে পারছেন না যেন প্রফেসর বেনজামিন। কিন্তু সে কেন চোর হবে? এসব কেন চুরি করতে যাবে?
হ্যাঁ, প্রফেসর, বিষণ্ণ ভঙ্গিতে মাথা কাত করলেন উইলসন। ছেলেটা ঠিকই বলেছে। আমি চোর। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই অপেক্ষা করে আছি মমি আর। কফিনটার জন্যে। কিন্তু লাভ কিছুই হল না। হাতে পেয়েও হারালাম দশ লক্ষ ডলার! কে জানে, বিশ কিংবা তিরিশ লক্ষও হতে পারে!
হ্যা! সামনে বাড়ল জলিল। কঠোর চোখে চেয়ে আছে উইলসনের দিকে। ও-ই সেই জ্যোতিষ! গলার স্বর, কথা বলার ধরন! …এখন চিনতে পারছি! এই লোকই গিয়েছিল আমার মনিবের বাড়িতে। বুঝিয়েছে, রা-অরকন তাদের পূর্বপুরুষ। ঠকিয়েছে ওঁদেরকে। লোকটা একটা ভণ্ড, শয়তান, মিথ্যুক! থুথু ছিটিয়ে দিল সে উইলসনের মুখে।
পকেট থেকে রুমাল বের করে মুছে ফেলল উইলসন। করুণ হয়ে উঠেছে। চেহারা, কেঁদে ফেলবে যেন। এসব আমার পাওনা! কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে মুখ তুললেন। প্রফেসর, শুনতে চান, কেন মমি আর কফিনটার জন্যে চোর হয়েছি আমি?।
নিশ্চয়! প্রায় চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর, ইচ্ছে করলেই, যখন খুশি আমার ওখানে গিয়ে মমিটা নিয়ে পরীক্ষা চালাতে পারতে তুমি। চুরি করতে গেলে কেন?
হাত তুলল কিশোর। এক মিনিট। আগে আমার একটা কথার জবাব দিন। মেথু আর ওয়েবকে ধরা হয়েছে?
বাইরে হাত-পা বেঁধে ফেলে রেখেছি ব্যাটাদের, জবাব দিল রোভার।
ছুটতে পারবে না তো?
মাথা নাড়ল রোভার।
উইলসনের দিকে ফিরল কিশোর। আপনার কথা এবার বলুন।