চিন্তার মোড় ঘোরাল কিশোর। কি করে ওদের হাত থেকে ছাড়া পাওয়া যাবে? যদি ঢাকনা খোলার সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠে দৌড় দেয়? অবাক হয়ে যাবে ওরা! কয়েক মুহূর্ত দেরি করে ফেলবে সক্রিয় হয়ে উঠতে। এই সুযোগে কি পালিয়ে যেতে পারবে?
মনে হয় না!–ভাবছে কিশোর। ওরা তিনজন। যেদিকেই ছোটার চেষ্টা করুক সে, কারও না কারও হাতে ধরা পড়বেই।…আচ্ছা, তার চাচা-চাচী কি কাঁদবে তার জন্যে? মন খারাপ করবে? মেরিচাচী নিশ্চয় কাঁদবে, এতে কোন সন্দেহ নেই তার। চাচাও কাঁদবে গোপনে। আর তার বন্ধুরা? মুসা আর রবিন?
ভাবতে ভাবতে গলার কাছে কি যেন দলামত একটা উঠে এল কিশোরের। এই সুন্দর পৃথিবীতে আর বেশিক্ষণ আয়ু নেই তার ঠিক এই সময় ছিন্ন হয়ে গেল। চিন্তাসূত্র। থেমে গেছে ট্রাক। উত্তেজিত হয়ে পড়ল কিশোর। ধক করে উঠেছে বুকের ভেতর। এসে গেছে সময়। যে-কোন মুহূর্তে উঠে এসে কফিন নামিয়ে নেবে মেখু আর ওয়েব।
কিন্তু এল না ওরা। মিনিট পাঁচেক পর আবার চলতে শুরু করল ট্রাক। মনে পড়ে গেল কিশোরের, অর্ধেক পথ এসে মক্কেলের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করার কথা দুই চোরের। নতুন নির্দেশ থাকলে, জেনে নেবে।
আবার নানারকম ভাবনা এসে ভিড় করল কিশোরের মনে। অতীতের অনেক স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছে, অনেক সুখের মুহূর্ত। অনেক কিছুই ভাবল সে, কিন্তু মুক্তির কোন উপায় বের করতে পারল না। সময়ের হিসেব রাখতে পারেনি কিশোর। আবার কতক্ষণ পর থামল ট্রাক, বলতে পারবে না।
লোহার দরজা উঠে যাওয়ার আওয়াজ শোনা গেল। উত্তেজিত হয়ে উঠেছে আবার কিশোর। টান টান হয়ে গেছে স্নায়ু। চলে গেছে বিষণ্ণ ভাবটা। শুয়ে শুয়ে কাপুরুষের মত মরবে না। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়ে যাবে। তবে, প্রথমে দৌড়ে পালানর চেষ্টা করবে।
ট্রাকের দরজা খুলে গেল। ভারি পায়ের শব্দ। উঠে এসেছে মেথু আর ওয়েব। নড়ে উঠল কফিন।
অদ্ভুত একটা কাণ্ড, জান! শোনা গেল ওয়েবের গলা। স্টোররুমে যখন ঠেলেছিলাম, একেবারে হালকা মনে হয়েছিল কফিনটা। যখন তুলতে গেলাম ট্রীকে, বেজায় ভারি। এখনও তাই!
অন্য সময় হলে, খুব একচোট হেসে নিত কিশোর। ওয়েবের বিস্মিত চেহারা সহজেই কল্পনা করতে পারছে। কফিনটার ওজন অন্তত একশো পাউণ্ড বাড়িয়ে দিয়েছে সে। এই ওজন অবাক করবেই ওয়েব কিংবা মেথুকে। সামনে ভয়ানক বিপদ, তাই হাসতে পারল না কিশোর।
ধরাধরি করে নামানো হল কফিনটা।
শোনা গেল তৃতীয় আরেকটা গলা। গ্যারেজের ভেতরে নিয়ে এস, জলদি! চাপী কণ্ঠস্বর, কিন্তু কেমন যেন পরিচিত মনে হল কিশোরের। এর আগে কোথাও শুনেছে! কোথায়?
আবার শূন্যে উঠল কফিন। খানিক পরেই ধপ করে নামানো হল আবার। সিমেন্টের মেঝেতে নামিয়েছে।
গুড, বলল তৃতীয় কণ্ঠ। মুখে রুমাল চেপে আছে নাকি! এমন চাপা কেন? মিনিট দশেকের জন্যে বাইরে যাও তোমরা। তারপর এসে নিয়ে যাবে মমি আর কফিন। আজই নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলবে।
আগে টাকা, তারপর রেব, গোঁয়ারের মত বলে উঠল ওয়েব। টাকা দাও, নইলে ছুঁতেও দেব না এটা।–
ঠিক আছে, ঠিক আছে, তাড়াতাড়ি বলল তৃতীয় কণ্ঠ। অর্ধেক পাবে এখন। পোড়াতে নিয়ে যাওয়ার আগে দেব বাকিটা।
খসখস আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। নিশ্চয় দড়ি খুলছে ওয়েব কিংবা মেথু। কফিনটাও নড়ে উঠল একবার।
আরে, দড়ি নিচ্ছ কোথায়? বলল মেথু। এখানেই থাক। আবার বেঁধে নিতে হবে না কফিনটা?
চল, টাকা নেবে, বলল তৃতীয় কন্ঠ। আহ্, জলদি এস!
দরজা নামানর শব্দ শুনল কিশোর। তার নীরবতা। ঘরে আর কেউ নেই, বোঝাই যাচ্ছে। আস্তে করে ঢাকনা তুলে উঁকি দিল সে। আবছা অন্ধকার। কাঁচের বদ্ধ শার্সি দিয়ে বাইরের আলো এসে পড়েছে ম্লান হয়ে। একটা গ্যারেজ, প্রাইভেট গ্যারেজ। ঘরে আর কেউ নেই। সাবধানে কোনরকম আওয়াজ না করে বেরিয়ে এল সে। জায়গামত নামিয়ে দিল আবার কফিনের ঢাকনা। ঠিক এই সময় আবার দরজা। উঠতে শুরু করল।
তড়াক করে লাফিয়ে এসে দরজার পাশে দেয়ালের গায়ে সেঁটে দাঁড়াল। কিশোর। অর্ধেক উঠেই থেমে গেল দরজা। ঘরে এসে ঢুকল এক লোক। টেনে আবার নামিয়ে দিল দরজা। উজ্জ্বল আলো থেকে এসেছে, বোধহয় সেজন্যেই আবছা অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা কিশোরকে দেখতে পেল না সে। ঘুরে এগিয়ে গেল। কফিনের দিকে। হাতের তালু ডলছে।
অবশেষে পেলাম! বিড়বিড় করে বলল লোকটা কফিনের পাশে দাঁড়িয়ে। এতগুলো বছর পর! পকেট থেকে একটা টর্চ বের করে আলো ফেলল কফিনটার ওপর। খুব বেশি সতর্ক, তাই গ্যারেজের আলো জ্বালছে না।
উবু হয়ে ঢাকনা তুলে নামিয়ে রাখল কাত করে, কফিনের গায়ে ঠেস দিয়ে। ঝুঁকে হাত বোলাতে শুরু করল কফিনের ভেতরের দেয়ালে। অনুভবে বোঝার চেষ্টা করছে কিছু।
স্প্রিঙের মত লাফিয়ে উঠল যেন কিশোর। দুই লাফে পৌঁছে গেল লোকটার পেছনে। জোরে এক ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল তাকে কফিনের ভেতর। ঠেলে ভেতরে। ঢুকিয়ে দিল পা দুটো। ঢাকনাটা তুলেই বসিয়ে দিল জায়গামত। তারপর চড়ে বসল। ওটার ওপর। মূল অপরাধীকে আটকে ফেলেছে। এরপর কি করবে? কতক্ষণ রাখতে পারবে আটকে?
ভেতর থেকে ধাক্কা দিতে শুরু করেছে লোকটা। চেঁচাচ্ছে। তবে খুব বেশি শোনা যাচ্ছে না চিৎকার। ঢাকনা বন্ধ, বাতাস চলাচল কতে পারছে না। গ্যারেজের দরজা নামানো। কিশোরই শুনতে পাচ্ছে না ভালমত, বাইরে থেকে শুনতে পাবে না মেখু কিংবা ওয়েব।