রোভার, থামুন, বলল কিশোর।
থেমে গেল ট্রাক। দ্রুত নেমে পড়ল চার কিশোর। আইসক্রীম স্ট্যাণ্ডটার সামনের চত্বরে এসে দাঁড়াল।
গতরাতে এটা দেখেছিলে? মনে পড়ে? জামানকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
হ্যাঁ, ওপরে-নিচে মাথা দোলাল জামান। আমি ভেবেছিলাম, মন্দির। অন্য বাড়িগুলোর চেয়ে চেহারা একেবারে আলাদা।
রবিন হাসল, ক্যালিফোর্নিয়ায় অনেক আজব জিনিসই দেখতে পাবে। কমলা আকৃতির কোন বিল্ডিং দেখলে, বুঝে নেবে ওখানে কমলার রস পাওয়া যায়। এই যে মন্দিরের চেহারা, ওরকম দেখলে বুঝতে হবে আইসক্রীম। আরও অনেক খাবার আছে, যেগুলোর আকৃতির সঙ্গে মিল রেখে তৈরি হয় বিল্ডিংগুলো। বিজ্ঞাপনও হয়, লোকের বুঝতেও সুবিধে হয়, ওটা কিসের দোকান।
আরও কিছু কথা জানার কৌতূহল হচ্ছিল জামানের, কিন্তু সময় নেই এখন।
আইসক্রীমের দোকানটা শুধু চিনল জামান আর মুসা, আশপাশের আর কিছু চিনতে পারল না। অন্ধকারে, উত্তেজনায় খেয়াল করেনি।
দ্রুত সিদ্ধান্ত নিল কিশোর। রবিন, তুমি আর জামান এখানে থাক। ওয়াকি টকি তৈরি রাখ। দরকার হলেই যাতে মেসেজ আদান-প্রদান করতে পার। মুসা, এই গলি, আর আশপাশের সবকটা কানা গলি খোঁজ। চিহ্ন দেখতে পেলেই রেডিওতে জানাবে। আমি যাচ্ছি উল্টোদিকে। খুঁজব। পেয়েও যেতে পারি ঠিক বাড়িটা। পুরো শহরতলীতে চিহ্ন আঁকতে পারেনি পুঁটকি, সেটা সম্ভবও নয়।
ঠিক আছে, দেখি চেষ্টা করে, মাথা কাত করল মুসা।
রোভার এখানেই ট্রাক রাখবে। এটাকেই ঘাঁটি ধরে নিতে হবে আমাদের। যে-ই ফিরে আসি, এখানে চলে আসব। সব সময় যোগাযোগ রাখব ওয়াকি-টকির মাধ্যমে। ঠিক আছে?
সায় জানাল সবাই।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। শিগগিরই অন্ধকার নামবে। দুই গলি ধরে দুদিকে রওনা হয়ে গেল মুসা আর কিশোর। ট্রাকের কাছে দাঁড়িয়ে রইল রবিন আর জামান।
কফিনটা যদি খুঁজে না পায় ওরা? বলল জামান। তাহলে মমিটাও পাবে না। চিরদিনের জন্যে হারাব আমরা রা-অরকনকে। কি করে এই দুঃসংবাদ জানাব গিয়ে বাবাকে? না আমি বলতে পারব, না জলিল!
কিশোরের কথা এখনও বিশ্বাস হয়নি জামানের, এখনও বিশ্বাস করছে রা অরকন তাদের পূর্বপুরুষ। ব্যাপারটা নিয়ে চাপাচাপি করল না রবিন। জিজ্ঞেস করল, জলিল কোথায়?
বাসায়ই বোধহয়, জবাব দিল জামান। বলল, ব্যবসার কাজে নাকি ব্যস্ত থাকবে আজ। কয়েকজন কার্পেট-ব্যবসায়ী আসবে। জরুরি আলোচনা আছে তাদের সঙ্গে।
কিসের কার্পেট-ব্যবসায়ী? দুই চোর মেথু আর ওয়েবের সঙ্গে দেখা করবে আসলে জলিল, ধরেই নিল রবিন। এমনিতেই বিষণ্ণ হয়ে আছে জামান। কথাটা জানিয়ে তাকে আরও দুঃখ দিতে ইচ্ছে হল না তার।
রবিন আর জামান কথা বলছে, ততক্ষণে কয়েকটা ব্লক দেখা হয়ে গেছে। কিশোর আর মুসার। পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে ওয়াকি-টকির মাধ্যমে। ব্যর্থতার কথা একটু পর পরই জানাচ্ছে একে অন্যকে। ইতিমধ্যে অন্ধকার হয়ে গেছে। চকের দাগ দেখাই যাবে না আর এখন।
পারলে আরও একটা গলি দেখ, সেকেণ্ড, হতাশ কণ্ঠে বলল কিশোর। তারপর ফিরে এস ট্রাকের কাছে। আলোচনা করে ঠিক করব, এরপর কি করা যায়!
বুঝেছি, খুদে স্পীকারে জবাব এল মুসার। আউট।
পরের গলিটা ধরে এগিয়ে চলল কিশোর। এর আগে যে কয়েকটা গুলি দেখেছে, ওটাও ওগুলোর চেয়ে আলাদা নয়। একই রকম দেখতে। ওই রকমই পুরানো ধাঁচের বাড়ি, দোকানপাট-বেশির ভাগই বন্ধ। ব্যবসা নিশ্চয় এদিকে ভাল জমে না। তাই সন্ধ্যার আগেই দোকান বন্ধ করে দিয়ে বাড়ি চলে গেছে। দোকানদাররা।
গলির প্রায় শেষ মাথায় বড় একটা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়াল কিশোর। বড় একটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা ট্রাক। পুরানো। নীল শরীর, জায়গায় জায়গায় চটে গেছে রঙ। দরজাটা তুলে দিয়েছে একজন লোক। কাজেই ওটাতে প্রশ্নবোধক আঁকা আছে কিনা, জানার উপায় নেই। দাঁড়িয়ে থেকেও লাভ নেই। ঘুরতে যাবে ঠিক এই সময় কানে এল কথা।
মেথু, ট্রাক ঢোকাও ভেতরে, বলল একজন।
ঢোকাচ্ছি। ড্রাইভিং সিটে বসা লোকটার গলা শোনা গেল, দরজার কাছ থেকে সর। এই, ওয়েব-হা, সর, আরও।
থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে আবার কিশোর। মেথু! ওয়েব! ট্রাক। বড় দরজা, বড় বাড়ি। আর কোন সন্দেহ নেই। এ-বাড়িটাই খুঁজছে ওরা।
.
১৫.
ছুটে ট্রাকের পাশে চলে এল কিশোর। ধীরে ধীরে ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে ট্রাক। হেডলাইট জ্বালেনি। গাঢ় অন্ধকার।
বাঁ পাশে রয়েছে ওয়েব। ট্রাকের ডান থেকে এগোল কিশোর। দরজার ফ্রেম আর ট্রাকের বডির মাঝে মাত্র দুফুট ফাঁক। ওই ফাঁক দিয়েই ভেতরে ঢুকে পড়ল
পুরো শরীরটা ভেতরে ঢুকে গেল ট্রাকের, থেমে দাঁড়াল। কিশোর দাঁড়িয়ে পড়ল ওটার পাশে, অন্ধকারে।
দরজা নামিয়ে দিচ্ছি আমি, শোনা গেল ওয়েবের গলা! তারপর হেডলাইট জ্বালবে। নইলে অন্ধকারে কিছু দেখতে পাব না।
ট্রাকের পাশে উবু হয়ে আছে কিশোর। দ্রুত চিন্তা চলছে মাথায়। কিছু দেখতে পাচ্ছে না। আলো জ্বলে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষাও করতে পারবে না। তাহলে চোরদের চোখে পড়ে যাবে। এর আগেই লুকিয়ে পড়তে হবে কোথাও। কোথায়?
বেশি ভাবনা-চিন্তার সময় নেই। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল সে মেঝেতে! গড়িয়ে। চলে এল ট্রাকের তলায়। দরজা নামানর প্রচণ্ড শব্দে ঢাকা পড়ে গেল তার গোনর মৃদু আওয়াজ। মুহূর্ত পরেই জ্বলে উঠল হেডলাইট। আলোকিত হয়ে উঠল ঘরের। অনেকখানি। দৃষ্টি সীমাবদ্ধ হয়ে আছে কিশোরের। তেমন কিছু দেখতে পাচ্ছে না। তবে পুরানো আমলের গাড়িটার চাকা আর কফিনের ওপরের ক্যানভাস ঠিকই চোখে। পড়ল।