কফিনটা এক রহস্য, এমনকি প্রফেসর বেনজামিনের কাছেও। ওটা তার গর্বের বস্তু।
প্রফেসর বেনজামিন, ছোটখাট একজন মানুষ, শরীরের তুলনায় ভুড়িটা সামান্য বড়, চেহারা আরও সম্ভ্রান্ত করে তুলেছে কাঁচাপাকা দাড়ি। চোখে গোল্ড-রিম চশমা।
তরুণ বয়সটা এবং তারপরেরও অনেকগুলো বছর মিশরেই কাটিয়েছেন। প্রফেসর। প্রত্নতাত্মিক অনেক অভিযানে অংশ নিয়েছেন। আবিষ্কার করেছেন অনেক পুরানো কবর, ঢুকেছেন পিরামিডের তলায়। দেখেছেন হাজার হাজার বছর আগের ফারাও, তাদের রানী আর চাকর-বাকরের মমি-বিচিত্র অলঙ্কার আর জিনিসে জড়ানো। মূর্তি আর অন্যান্য জিনিসপত্র ওখান থেকেই সংগ্রহ করেছেন। কয়েক বছর আগে ফিরে এসেছেন দেশে। প্রাচীন মিশরে তাঁর আবিষ্কার আর অভিযানের ওপর একটা বই লিখেছেন।
ওই কফিন আর ভেতরের মমিটা তার কাছে এসে পৌঁছেছে মাত্র এক হপ্তা হল। এটা তিনি আবিষ্কার করেছিলেন প্রায় পঁচিশ বছর আগে। সে সময় এবং তার পরের অনেকগুলো বছর খুব ব্যস্ত ছিলেন, নজর দিতে পারেননি মমিটার দিকে। ওটা গচ্ছিত রেখেছিলেন কায়রোর এক জাদুঘরে। দেশে ফিরে চিঠি লিখেছেন। জাদুঘর কর্তৃপক্ষ মমিটা পাঠিয়ে দিয়েছে প্রফেসরের ঠিকানায়, ওটার ওপর প্রচুর। গবেষণা চালানর ইচ্ছে আছে তাঁর।
মি. ক্রিস্টোফার তিন গোয়েন্দাকে চিঠি পাঠানর দুদিন আগে।
জানালার কাছে দাঁড়িয়ে আছেন প্রফেসর বেনজামিন। গভীর চিন্তায় মগ্ন। মাঝে মাঝে হাতের পেন্সিল দিয়ে আস্তে টোকা দিচ্ছেন কফিনের ডালায়। এত সাধারণ একটা কাঠের কফিনে কেন রাখা হয়েছে এই মমি! বুঝতে পারছেন না প্রফেসর। কেমন অস্বস্তি বোধ করছেন।
প্রফেসরের কাছেই দাঁড়িয়ে আছে তার খানসামা হুপার। লম্বা, রোগাটে একজন। মানুষ। অনেক বছর ধরে কাজ করছে তার এখানে।
স্যার, আবার খুলতে চান এটা? বলল হুপার। গতকাল ওই কাণ্ড ঘটার। পরেও?
আবার ঘটুক, তাই আমি চাই, জোর দিয়ে বললেন প্রফেসর। জানালাগুলো খুলে দাও। কতবার না বলেছি, বন্ধ ঘরে দম আটকে আসে আমার!
এই দিচ্ছি, স্যার, তাড়াতাড়ি কাছের জানালাটা খুলে দিল হুপার। অন্যগুলোও, খুলতে এগোল।
কয়েক বছর আগে একটা কবরে আটকা পড়ে যান প্রফেসর বেনজামিন। দুদিন ওই বন্ধ ঘরে আটকে থাকার পর বের করে আনা হয় তাকে। সেই থেকেই বন্ধ যে-কোন রকম ঘরের ব্যাপারে একটা আতঙ্ক জন্মেছে তার।
সবকটা জানালা খুলে দিয়ে এল হুপার। ডিবার ডালার মত আলগা চারকোনা কফিনের ডালা। তুলে ওটা কফিনের পাশেই দাঁড় করিয়ে রাখল সে। দুজনেই সামান্য ঝুঁকে তাকাল কফিনের ভেতরে।
বাহু, তোমার সাহস আছে বলতে হবে, হুপার, প্রশংসা করলেন প্রফেসর। অনেকেই মমির দিকে তাকাতে সাহস করে না। অথচ একে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বিটুমিন আর অন্যান্য আরকে ভিজিয়ে, লিনেন জড়িয়ে রাখা হত হাজার হাজার বছর আগের মিশরীয় রাজ-রাজাদের দেহ। হয়ত ওদের বিশ্বাস ছিল, দেহটা ঠিক থাকলে মৃত্যুর পরের জগতে ঢোকা খুব সহজ হবে। আরেক দুনিয়ায় গিয়ে যাতে কোনরকম অসুবিধা না হয়, সেজন্যে সঙ্গে দেয়া হত সব রকমের দরকারি জিনিসপত্র। চাকর-বাকরদেরও মেরে মমি বানিয়ে রেখে দেয়া হত রাজার পাশের কোন কক্ষে। আরেক জগতে চাকরেরও অভাব হবে না রাজার, এই বিশ্বাসে। কী অদ্ভুত ধর্ম, আর বিশ্বাস! আবার মমিটার দিকে তাকালেন তিনি। ভেতরের দিকে কফিনের গায়ে খোদাই করা আছে, রা-অরকন-এর নাম। মমি জড়িয়ে থাকা লিনেনের একটা অংশ খোলা। ফলে রা-অরকনের চেহারা দেখা যাচ্ছে। গাঢ় রঙের। কাঠ কুঁদে তৈরি যেন মুখ। ঠোঁট সামান্য ফাঁক হয়ে আছে, কথা বলতে চায় বুঝি! চোখ বোজা।
রা-অরকনকে আজ খুব শান্ত মনে হচ্ছে, স্যার, বলল হুপার। আজ হয়ত কথা বলবে না।
না বললেই ভাল। তিন হাজার বছরের পুরানো মমি কথা বলে এটা খুবই অস্বাভাবিক!
হ্যাঁ, স্যার!
অথচ, গতকাল ফিসফিস করে কি যেন বলেছিল! আপনমনেই বললেন। প্রফেসর। গতকাল এঘরে একা ছিলাম, হুপার, তখন কথা বলে উঠছিল মমিটা। অদ্ভুত ভাষা, বুঝিনি! তবে কথার ধরনে মনে হয়েছে আমাকে কিছু একটা করতে বলছে ও!
মমিটার ওপর আবার ঝুঁকলেন প্রফেসর। রা-অরকন, আজও কি আমার সঙ্গে কথা বলতে চান? বলুন। আমি শুনছি।
চুপ করে রইল মমি। এক মিনিট কাটল। দুই। ঘরে এসে ঢুকেছে একটা মাছি, ওটার ভনভন ছাড়া আর কোন আওয়াজ নেই।
আমার কল্পনাও হতে পারে, আপনমনেই কথা বলছেন প্রফেসর। না, কাল কোন কথা বলেনি মমি। ওটা নিছকই আমার কল্পনা। হুপার, ওয়ার্কশপ থেকে ছোট করাতটা নিয়ে এস। কফিন থেকে ছোট এক টুকরো কাঠ কেটে নেব, আজই পাঠাব। ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতে। কার্বন টেস্ট করিয়ে মমিটার আসল বয়স জানা দরকার।
ঠিক আছে, স্যার, যাচ্ছি। বেরিয়ে গেল হুপার।
কফিনের ওপর ঝুঁকলেন প্রফেসর। টোকা দিয়ে দিয়ে দেখলেন। কোথা থেকে। কাটলে ভাল হবে? একটা জায়গায় ফাপা মনে হল টোকার শব্দ। চিলতে কাঠ ভরে ফোকরের মুখ বন্ধ করা হয়েছে যেন।
কাজে মগ্ন প্রফেসর। হঠাৎ কানে এল চাপা বিড়বিড় শব্দ, কফিনের ভেতর থেকেই আসছে! ঝট করে সোজা হয়ে গেলেন তিনি। চোখে অবিশ্বাস। আবার ঝুঁকে মমির ঠোঁটের কাছে কান নিয়ে গেলেন।
হ্যাঁ, মমিই! ফিসফিস করে কি যেন বলছে! সামান্য ফাঁক করা ঠোঁটের ভেতর। থেকেই যেন বেরিয়ে আসছে শব্দগুলো। মিশরীয় ভাষা, কোন সন্দেহ নেই। তবে ঠিক কোন ভাষা, বোঝা গেল না। তিন হাজার বছর আগের কোন ভাষা হবে, অনুমান করলেন তিনি। একটা শব্দও বুঝতে পারছেন না প্রফেসর। কেমন খসখসে কণ্ঠস্বর, কথার ফাঁকে ফাঁকে চাপা হিসহিসানি। এতই নিচু কণ্ঠস্বর, কোনমতে শুনতে পাচ্ছেন তিনি। মাঝে মাঝে বেড়ে গিয়ে পরক্ষণেই আবার ঝপ করে খাদে। নেমে যাচ্ছে আওয়াজ। মমিটা তাকে কিছু বোঝনর জোর চেষ্টা চালাচ্ছে যেন।