ঠিকরে বেরিয়ে আসবে যেন মুসার দুই চোখ। খাইছে! শুধু ওই খাম আর চিঠির কাগজ দেখেই এত কিছু জেনে গেলে!
নিশ্চয়, রবিন নির্লিপ্ত। আর হ্যাঁ, মহিলা খুব ধনী। সমাজসেবা করেন।
রবিনের হাত থেকে খাম আর চিঠিটা নিল মুসা। উল্টেপাল্টে দেখল। ভুরু কুঁচকে গেছে। অবশেষে আগের জায়গায় ফিরে গেল আবার ভুরু। বেড়ালের বাচ্চার ছবি দেখেই বোঝা যাচ্ছে, মহিলা বেড়াল ভালবাসেন। স্ট্যাম্পের পাতা থেকে তাড়াহুড়ো করে খুলেছেন স্ট্যাম্প, একটা কোণ ছিঁড়ে গেছে, তারমানে খামখেয়ালী। লেখার স্টাইল দেখে বোঝা যাচ্ছে, হাসিখুশি। নিচের লাইনগুলো আঁকাবাকা, লেখাও কেমন খারাপ, অর্থাৎ কোন একটা ব্যাপার নিয়ে দুশ্চিন্তা করছেন।
মাথা ঝাঁকাল রবিন। ঠিক জায়গায় নজর দিতে পারলে ডিডাকশন খুব সহজ।
হ্যাঁ, স্বীকার করল মুসা। শার্লক হোমস কিংবা কিশোর পাশার শাগরেদ হতে পারলে, এ-বিদ্যা শেখা আরও সহজ। কিন্তু, তুমিও কম না। মহিলার বয়স, আকৃতি, ধনী, চুলে রঙ করেন, বেশি কথা বলেন, এগুলো জানলে কি দেখে?
হাসল রবিন। খামের কোণে মহিলার ঠিকানা রয়েছে। সান্তা মনিকার। জায়গাটা ধনীদের এলাকা, জানই। আর ওখানকার ধনী বয়স্কা মহিলাদের সময় কাটানর জন্যে সমাজসেবা ছাড়া আর তেমন কিছুই করার নেই।
বেশ, বুঝলাম। কিন্তু চুলের রঙ? বয়স? বেশি কথা বলে? আকৃতি? এসব কি করে বুঝলে?
বুঝেছি, সহজ গলায় জবাব দিল রবিন। লাইলাক ফুলের রঙ আর গন্ধ পছন্দ মহিলার, সবুজ কালিতে লেখেন। বয়স্কা মহিলাদেরই এসব রঙ আর গন্ধ। বেশি পছন্দ। আমার খালাও পছন্দ করেন। তার বয়েস পঞ্চাশের কাছাকাছি, মোটাসোটা, বেঁটে, বেশি কথা বলেন, চুলে রঙ লাগান-তবে চিঠি লেখিকার ব্যাপারে এসব সত্যি না-ও হতে পারে। স্রেফ অনুমান করেছি। শিওর বলতে পারব না। চিঠির নিচে সইটা আরেকবার দেখল রবিন। তবে একেবারে ভুল, তাও বলব না। আমার খালা আর এই মিসেস ভেড়া চ্যানেলের অনেক কিছুতেই মিল দেখতে পাচ্ছি।
হাসল মুসা। আমাকে বোকাই বানিয়ে ফেলেছিলে। তবে, ডিডাকশন ভালই করেছ। শেষগুলো সত্যি হলে একশোতে একশোই দেয়া যায়। আচ্ছা, এবার দেখা যাক, কি লিখেছেন মহিলা।
চিঠিটা মুসাকে শুনিয়ে জোরে জোরে পড়ল রবিন। মিসেস চ্যানেলের একটা আবিসিনিয়ান বেড়াল ছিল, নাম স্ফিঙ্কস। মহিলার খুব আদরের প্রাণী। হপ্তাখানেক আগে নিখোঁজ। পুলিশকে খবর দিয়েও লাভ হয়নি, তারা বেড়ালের ব্যাপারে উদাসীন। খবরের কাগজে ইদানীং তিন গোয়েন্দার খুব নাম দেখে চিঠি পাঠিয়েছেন। যদি তারা তার বেড়ালটা খুঁজে বের করে দেয়, কৃতজ্ঞ হবেন।
বেড়াল নিখোঁজ, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল মুসা, আমাদের জন্যে কেসটা ভালই। সহজ, বিপদ নেই, কোনরকম ভয়ের কারণ নেই। মহিলাকে রিং করে বলি, কেসটা নিলাম…
দাঁড়াও, মাথা তুলল রবিন। মিস্টার ক্রিস্টোফার কি লিখেছেন, পড়ি আগে।
হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, ফোনের দিকে এগোতে গিয়েও দাঁড়িয়ে পড়েছে মুসা।
দ্বিতীয় খামটা খুলে ফেলল রবিন। খুব দামি বণ্ড পেপারে লেখা একটা চিঠি। ওপরে একপাশে বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফারের নাম-ঠিকানা ছাপা।
মুসাকে শুনিয়ে পড়তে শুরু করল রবিন। প্রথম বাক্যটা পড়েই থমকে গেল। তারপর খুব দ্রুত চোখ বোলাল পরের লাইনগুলোর ওপর। মুখ তুলে দেখল, অবাক হয়ে তার দিকে চেয়ে আছে গোয়েন্দা-সহকারী।
সর্বনাশ! জোরে কথা বলতেও ভয় পাচ্ছে যেন রবিন। চিঠিটা বাড়িয়ে দিল বন্ধুর দিকে। নাও, নিজেই পড়। আমি বললে বিশ্বাস করবে না।
নীরবে চিঠিটা নিল মুসা। রবিনের মতই দ্রুত পড়ে শেষ করল। মুখ তুলে। তাকাল রবিনের দিকে। বিস্ময়ে কোটর থেকে যেন ঠিকরে বেরিয়ে আসছে তার চোখ। ইয়াল্লা! ফিসফিস করে বলল। তিন হাজার বছরের পুরানো মমি কথা বলে।
.
০২.
রকি বীচ থেকে মাইল বারো দূরে, হলিউডের বাইরে একটা গিরিসঙ্কট। পাহাড়ের মমি ঢালে এখানে কয়েকটা বড়সড় বাংলোমত বাড়ি, প্রচুর পয়সা খরচ করে তৈরি হয়েছে। বাড়িগুলোকে ঘিরে আছে গাছপালা, ঝোঁপঝাড়। পুরানো স্প্যানিশ রীতির। একটা বড় বাড়ি আছে, একটা অংশকে ব্যক্তিগত, জাদুঘর বানিয়ে নিয়েছেন বাড়ির মালিক প্রফেসর বেনজামিন, একজন বিখ্যাত ইজিপটোলজিস্ট-মিশর-তত্ত্ববিদ। প্রাচীন মিশর ও পিরামিড সম্পর্কে তার অগাধ জ্ঞান।
বাড়িটার জানালাগুলো আবার ফরাসী রীতির, বড় বড় জানালা প্রায় মেঝে ছুঁই ছুঁই করছে। একটা বিশেষ ঘরের জানালা বন্ধ। সেই জানালার পাশে সারি দিয়ে। সাজানো কয়েকটা মূর্তি, প্রাচীন মিশরীয় কবর খুঁড়ে বের করে আনা। একটা মূর্তি ভারি কাঠের তৈরি। শরীর মানুষের, মুখটা শেয়ালের। প্রাচীন দেবতা, আনুবিস। শার্সি ভেদ করে ঢুকছে পড়ন্ত বিকেলের রোদ, মেঝেতে ছায়া পড়েছে আনুবিসের। শেয়ালের মত মুখের ছায়া অনেকটা বেশি লম্বা হয়ে পড়েছে মেঝেতে, দেখলেই গা ছমছম করে।
মিশরের পিরামিড আর প্রাচীন কবর থেকে তুলে আনা আরও সব জিনিসে প্রায় ঠাসা ঘরটা। দেয়ালে ঝুলছে ধাতব মুখোশ, সে মুখোশের বিকৃত ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। মাটির তৈরি চাকতি আর ছোট ছোট ফলক, সোনার গয়না, সবুজ পাথর থেকে খোদাই করা পবিত্র গুবরে পোকার প্রতিকৃতি সাজানো রয়েছে কাঁচের বাক্সে। একটা জানালার কাছে রাখা আছে একটা মমির-কফিন, কাঠের তৈরি ডালা আটকানো। অতি সাধারণ কফিন। গায়ে সোনার পাত নেই, নেই রঙে আঁকা কোনরকম নকশা বা ছবি। বিলাসিতা বা আড়ম্বরের কোন ছাপই নেই ওটাতে।