রা-অরকনকে নিয়ে গেছে! ছেলেটার প্রশ্ন যেন শুনতে পায়নি মুসা। বিশ্বাস করতে পারছি না!
আমি সত্যি বলছি, দৃঢ়কণ্ঠে বলল ছেলেটা। জামান বংশের জামান কখনও মিছে কথা বলে না।
ছেলেটাকে ধরে রেখেই জানালা দিয়ে কফিনটার দিকে তাকাল মুসা। ঠিক আগের জায়গাতে আগের মতই রয়েছে। বিন্দুমাত্র সরেনি কোনদিকে। কিন্তু ছেলেটা বলছে, সে সত্যি কথা বলছে। তাহলে?
শোন, খোকাবাবু, বলল মুসা। শুনেছি, মমিটা প্রফেসর বেনজামিনের সঙ্গে কথা বলে। ওই রহস্যের সমাধান করতেই এসেছি আমরা। কেন, কি কথা বলে, কি করে বলে, বলতে পারবে কিছু?
বিস্ময় ফুটল ছেলেটার চোখে। দাদা রা-অরকন কথা বলে! আশ্চর্য! না, আমি কিছু বলতে পারব না!
আমরাও কিছু বুঝতে পারিনি এখনও, বলল মুসা। মমিটার ব্যাপারে অনেক কিছু জান মনে হচ্ছে। আমি কিছু কিছু জানি, হয়ত সেটা তুমি জান না। এ-বাড়ির ওপর চোখ রেখেছ কেন? সকালে ঝোঁপের ভেতর কেন লুকিয়েছিলে? কোন অসুবিধে না থাকলে বলে ফেল। হয়ত মমি-রহস্যের সমাধান করে ফেলতে পারব আমরা। মানে, কি করে কথা বলে, কি বলে, জানতে পারব। কি, বলবে?
দ্বিধা করছে ছেলেটা। তারপর মাথা নাড়ল। বেশ, বলব সব। জামান বংশের জামান বিশ্বাস করল তোমাকে। হাত ছাড়, ব্যথা পাচ্ছি।
হাত ছেড়ে দিল মুসা।
কজির কাছটায় ডলতে লাগল ছেলেটা। ঝোঁপের দিকে চেয়ে তার নিজের ভাষায় কিছু বলল চেঁচিয়ে।
কি বলছ? জানতে চাইল মুসা।
আমার বেড়ালটাকে ডাকছি। ওর ভেতরে বাস করে রা-অরকনের আত্মা। মমিটা খুঁজে পেতে সাহায্য করবে ওটা আমাদের।
অপেক্ষা করে রইল দুজনে। কিন্তু এল না বেড়ালটা।
বলেছিলাম না? অবশেষে বলল মুসা। ওটা তোমার বেড়াল নয়। মিসেস চ্যানেলের। নাম, ফিঙ্কস। আবিসিনিয়ার বেড়াল, পিঙ্গল শরীর। সামনের দুই পা সাদা। দুই চোখ দুই রঙের। মহিলার বর্ণনার সঙ্গে হুবহু মিলে যাচ্ছে।
না, গভীর আস্থা ছেলেটার কণ্ঠে। পা সাদা নয়, কালো। রা-অরকনের প্রিয় বেড়াল। যেটাকে মেরে মমি করে কফিনে তার সঙ্গে দিয়ে দেয়া হয়েছিল হাজার হাজার বছর আগে।
দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ল মুসা। বড় বেশি আত্মবিশ্বাস নিয়ে কথা বলছে জামান বংশের জামান। বেড়ালটার পায়ের রং সাদাই দেখেছে কিনা, মনে করতে পারছে না। ভাবনায় পড়ে গেল। ঠিক আছে, এ নিয়ে পরে ভাবব। এস দেখি, তোমার কথা ঠিক কিনা। সত্যিই চুরি গেছে কিনা মমিটা।
জানালা গলে দুজনে ঢুকল জাদুঘরে। ধরাধরি করে তুলে ফেলল কফিনের ঢাকনা। ঠিকই বলেছে জামান বংশের জামান। শূন্য কফিন।
ইয়াল্লা! বিড়বিড় করল মুসা। কে নিল!
তোমাদেরই কেউ নিয়েছে! চুরি করেছে আমার দাদাকে! ঝাঁঝালো কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল ছেলেটা।
না, জামান, চিন্তিত ভঙ্গিতে বলল মুসা। এই চুরির ব্যাপারে কিছু জানি না আমি। তোমাদের বলতে কাকে বোঝাতে চাইছ? এ-বাড়িতে আমরা তিন বন্ধু এসেছি। অন্য দুজন আমার বয়েসী। মমিটা কথা বলে কেন, সে রহস্য ভেদ করতে এসেছি। সে যাই হোক, মমিটা সম্পর্কে তুমি যা জান বল, আমি যা জানি বলব। হয়ত একটা সমাধান বেরিয়েও যেতে পারে। কে চুরি করল মমিটা, তা-ও জেনে যেতে পারি হয়ত।
কি যেন ভাবল জামান। মাথা কাত করল, বেশ, কি জানতে চাও?
আমার প্রথম প্রশ্ন, রা-অরকনকে দাদা বলছ কেন?
জামান বংশের অনেক প্রাচীন পূর্বপুরুষ রা-অরকন, গর্বিত কণ্ঠ জামানের। তিন হাজার বছর আগে লিবিয়ানরা গিয়ে মিশর শাসন করেছিল। রা-অরকন লিবিয়ান। তিনি ছিলেন এক মহান রাজা। অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতেন না বলে, অত্যাচারীকে কঠোর হাতে দমন করতেন বলে, খুন করা হয় তাকে। তার লাশ নষ্ট করে ফেলতে পারে শত্রুরা-জান হয়ত, মমি নষ্ট করে ফেললে সেই লোকের আত্মা আর পরপারে গিয়ে ঠাই পায় না, প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস ছিল, তাই গোপনে গোপন জায়গায় কবর দেয়া হল তাঁকে। বিনা আড়ম্বরে। তাঁর বংশের এক ছেলে। আবার লিবিয়ায় ফিরে গিয়েছিল। সেই ছেলেরই বংশধর আমরা।
জানলে কি করে এত সব? কোন প্রাচীন ডায়েরীটায়েরী…মানে ফলকে। লেখা—
মাথা নাড়ল জামান। না, ওরকম কিছু না। এক জ্যোতিষের কাছে জেনেছেন। এটা বাবা। মহা অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ওই জ্যোতিষ। অতীত-ভবিষ্যৎ সব বলে দিতে পারে। সে-ই জানিয়েছে, রা-অরকনকে অনেক দূরের এক দেশে নিয়ে যাওয়া হয়েছে মিশর থেকে, বর্বরদের দেশে। ওখানে মোটেই শান্তি পাচ্ছেন না রা অরকন, তার ঘুমের খুব ব্যাঘাত ঘটছে। আমার বাবা অসুস্থ, তাই মমিটা নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন জলিলকে। সে আমাদের ম্যানেজার। সঙ্গে দিয়েছেন আমাকে। বংশের কেউ নিতে না এলে যদি কিছু মনে করে রা-অরকন, সেজন্যে।
অন্য সময় হলে বর্বর শব্দটার প্রতিবাদ করত মুসা। কিন্তু এখন অন্য ভাবনা চলেছে মাথায়। সকালে প্রফেসর বেনজামিন বলেছেন, একজন অ্যারাবিয়ান ব্যবসায়ী মমিটা নিতে এসেছিল। তার নাম জলিল। লোকটাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি। ও, এই জন্যেই এ বাড়ির আশপাশে এত ঘোরাফেরা তোমার? বলল মুসা। তুমি আর জলিল মিলে রা-অরকনকে চুরি করার ফন্দি এঁটেছিলে নাকি?
বর্বর প্রফেসর আমার দাদাকে দিল না, বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল জামান, আর কি করব? কিন্তু চুরি বলছ কেন এটাকে? আমাদের জিনিস জোর করে দখল করেছে সে। আর কোন উপায় নেই আমাদের। তাই ওকে না জানিয়েই নিয়ে যেতে চেয়েছি। দাদার আত্মার শান্তির জন্যে জান দিয়ে দিতেও আপত্তি নেই আমার। বংশের কারও অপমান সহ্য করে না জামান বংশের লোকেরা।