কিন্তু এখনও দরজা খুলছে না কেন হুপার? অবাক হল মুসা। আবার বাজাল বেল। সাড়া নেই। চেঁচিয়ে ডাকল সে হুপারের নাম ধরে। তবু জবাব নেই।
চারদিকে তাকাল মুসা। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ছে না। গলা আরও চড়িয়ে ডাকল হুপারকে। সাড়া না পেয়ে ঘুরে দাঁড়াল। চলল জাদুঘরের দিকে। জানালা খোলা। আলো জ্বলছে ওঘরেই। ভেতরে ঢুকে পড়ল সে। কফিনটা জায়গামতই রয়েছে। জানালার কাছে তেমনি দাঁড়িয়ে রয়েছে দেবতা আনুবিসের মূর্তি। কোন রকম গোলমাল চোখে পড়ল না তার। কিন্তু তবু অস্বস্তি বোধ করতে লাগল সে। মনে হচ্ছে, দেখা যাচ্ছে না বটে, কিন্তু কোথাও কিছু একটা গণ্ডগোল হয়েছে। কি সেটা? মেরুদণ্ডে অদ্ভুত এক ধরনের শিরশিরে অনুভূতি হচ্ছে এখন।
কফিনের ঢাকনা তুলে দেখার ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু ভরসা পাচ্ছে না। যদি একা পেয়ে তার সঙ্গে কথা বলতে শুরু করে মমিটা? থাক, বাবা, খুলে কাজ নেই। ইচ্ছেটা বাতিল করে দিল মুসা। পায়ে পায়ে এগিয়ে গেল সেই জানালাটার কাছে, যেটা দিয়ে দেখা যায় প্রফেসর উইলসনের বাড়ি। উঁকি দিল বাইরে। অন্ধকার বাগান। ঘরের আলো পড়েছে খানিকটা জায়গায়, তাতে আশপাশটা আরও বেশি অন্ধকার দেখাচ্ছে। কালো আকাশে অগুনতি তারা। এক বিন্দু বাতাস নেই, গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। কালো ঝোঁপগুলোর দিকে চেয়ে মেরুদণ্ডের শিরশিরে অনুভূতিটা ফিরে এল আবার। হঠাৎই ভয় পেতে শুরু করেছে সে। গেল কোথায় সব? কোন অঘটন ঘটল না তো? ঘুরে দাঁড়ানর আগের মুহূর্তে চোখে পড়ল। জিনিসটা। জানালা দিয়ে আলো পড়েছে বাগানে। আলো আর অন্ধকারের সীমারেখার কাছে চকচক করছে কিছু একটা।
ভয় নেই, বলে মনকে বোঝানর চেষ্টা করল মুসা। সাহস সঞ্চয় করে জানালা টপকে নামল বাগানে। কাছে গিয়ে তুলে নিল চকচকে জিনিসটা। একটা তলোয়ার। অনেক পুরানো, ব্রোঞ্জের তৈরি। নিশ্চয় প্রফেসর বেনজামিনের সংগ্রহের জিনিস। ঠিক এই সময় মৃদু একটা শব্দ হল পেছনে। ধক করে উঠল মুসার বুকের ভেতর। পাই করে ঘুরল।
ঝোঁপের ভেতর নড়ছে কিছু একটা। পরমুহূর্তেই বেরিয়ে এল ছোট একটা চারপেয়ে জীব। ধীরে ধীরে কাছ চলে এল। বেড়াল। মুখ তুলে তাকাল মুসার দিকে। পরক্ষণেই তার পায়ে গা ঘষতে শুরু করল। মৃদু ঘড়ঘড় শব্দ করছে। আদর চাইছে বোধহয়।
হেসে ফেলল মুসা। দূর হয়ে গেছে উত্তেজনা, শঙ্কা, ভয়। তলোয়ারটা মাটিতে রেখে বেড়ালটাকে তুলে নিল দুহাতে। সুন্দর একটা বেড়াল। হুলো। বেশ বড়। পিঙ্গল রঙ। মৃদু ঘড়ঘড় করেই চলেছে। দুপা এগিয়ে আলোতে এসে দাঁড়াল মুসা। এই সময় মুখ তুলে তাকাল বেড়ালটা তার দিকে। হাত থেকেই প্রায় ছেড়েই দিচ্ছিল। ওটাকে মুসা। নিজের অজান্তেই চাপা একটা শব্দ করে উঠল, ইয়াল্লা! এটা। ফিস। মিসেস চ্যানেলের বেড়াল!-ভাবছে মুসা। এটা এখানে এল কি করে? যেভাবেই আসুক, কপালগুণেই খুঁজে পেয়েছে সে এটাকে। কিশোরের দিকে চেয়ে। খুব একখান হাসি দিতে পারবে এবারে। এত তাড়াতাড়ি সমাধান হয়ে গেছে কেস।
জানালার দিকে পা বাড়াল মুসা, ঠিক এই সময় ভারি একটা কিছু এসে পড়ল তার ওপর, পেছন থেকে। চেঁচিয়ে উঠে হাত থেকে বেড়ালটাকে ছেড়ে দিল সে। তাল সামলাতে না পেরে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল ঘাসের ওপর। পিঠের ওপর চেপে এল একটা ভারি কিছু।
এক মুহূর্ত। তারপরই হুশ ফিরে পেল মুসা। এক গড়ান দিয়েই সরে গেল, পিঠের ওপর থেকে ফেলে দিল বোঝাটা। পাশ ফিরে তাকাল। সেই ছেলেটা। সকালে ঝোঁপের ভেতর বসে ছিল যে, যাকে ধরে ফেলেছিল। ছেলেটা উঠে দাঁড়ানর আগেই বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন মুসার শরীরে। চার হাত পায়ে ভর দিয়ে চিতার মত লাফিয়ে পড়ল ছেলেটার ওপর। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল কোমর। এবার আর ছাড়বে না কিছুতেই।
অনেক চেষ্টা করল ছেলেটা, কিন্তু ছাড়া পেল না মুসার হাত থেকে।
মুসা আমানের হাতে পড়েছ, খোকাবাবু, বলল গোয়েন্দাসহকারী, সহজে ছাড়া পাচ্ছ না আর। কে তুমি? এদিকে এত ঘোরাফেরা কিসের? আমাকে আক্রমণ করছ কেন?
আবার ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করল ছেলেটা। তারপর হাল ছেড়ে দিল। চেঁচিয়ে উঠল ইংরেজিতে, তোমরা আমার দাদা রা-অরকনকে চুরি করেছ! আমার বেড়ালটাকে ধরে রাখতে চাইছ! কিন্তু আমি জামান বংশের ছেলে জামান, সেটা কিছুতেই হতে দেব না!
দাদা রা-অরকন! চুরি করেছি! মুসা অবাক। আর ওটা তোমার বেড়াল? ভুল করছ, খোকাবাবু। বেড়ালটা তোমার নয়। ওটার মালিক মিসেস ভেরা চ্যানেল। আর আমি ওটাকে ধরে রাখতে চাইনি। ওটাই আমার কাছে এসেছে। খাতির করতে চেয়েছে। ঠেলতে ঠেলতে ছেলেটাকে জানালার কাছে নিয়ে এল মুসা। কোমর ছেড়ে দিয়ে কব্জি চেপে ধরল।
মুসার দিকে চেয়ে আছে ছেলেটা। ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করছে না আর। তামাটে চামড়ার রঙ, কুচকুচে কালো বড় বড় দুটো চোখ। কুটি করল। তুমি দাদা রা-অরকনের ব্যাপারে কিছু জান না! ওকে চুরি করনি?
কি বলছ তাই বুঝতে পারছি না, বলল মুসা। মমিটার কথা বলছ? তাহলে ওটাকে দাদা-দাদা করছ কেন? ওটা তিন হাজার বছরের পুরানো। তোমার দাদা হয়। কি করে? কফিনের ভেতরে রয়েছে এখন। চুরি করিনি। আর করতে যাবই বা কেন?
মাথা নাড়ল ছেলেটা। কফিনের ভেতর নেই এখন ওটা।
নেই!
না, নেই। খানিক আগে দুটো লোক এসে নিয়ে গেছে। এতে তোমার কোন হাত নেই বলতে চাইছ?