যেখানে যেটা যেভাবে রাখা ছিল, তেমনি রয়েছে। কোন রকম নড়চড় হয়নি। তেমনি পড়ে আছে কফিনটা, ডালা বন্ধ। জানালা বন্ধ করে গিয়েছিল, বন্ধই আছে।
এগিয়ে গিয়ে একটা জানালা খুলল। ভয়ে ভয়ে পা টিপে টিপে নামল চত্বরে। ঠিক তখনই আবার কানে এল শব্দটা। অদ্ভুত খসখসে ভাষায় কি একটা আদেশ দিল যেন কেউ! কে কাকে আদেশ দিল! তাকেই নয় তো! প্রচণ্ড ভয় পেয়ে গেছে। হুপার। দুরুদুরু করছে বুকের ভেতর। পাগলের মত চারদিকে তাকাচ্ছে।
একপাশে একটা ঝোঁপের ভেতর নড়াচড়া লক্ষ্য করল। তলোয়ারটা তুলে ধরল। আত্মরক্ষার তাগিদে। আবছা অন্ধকারে দেখল, বেরিয়ে আসছে একটা মূর্তি। দেহটা মানুষের, তবে গলার ওপরের অংশ পুরোপুরি শেয়াল। দুই চোখ জ্বলছে।
আনুবিস! ফিসফিস করে নিজেকেই যেন বলল হুপার। শেয়ালদেবতা!
এক পা সামনে বাড়ল আনুবিস। ধীরে ধীরে তুলল ডান হাত। টান টান সোজা করল সামনের দিকে। তর্জনী নির্দেশ করছে হুপারকে।
ঠিক বুঝতে পারল না হুপার, কি ঘটল। অস্বাভাবিক দুর্বল বোধ করছে। চোখের পলকে যেন অদ্ভুত পরিবর্তন ঘটে গেছে তার শরীরের যন্ত্রপাতিগুলোতে। হাত থেকে খসে পড়ল তলোয়ার। সেই সঙ্গে লুটিয়ে পড়ল সে-ও।
.
০৮.
দাঁড়িয়ে পড়ল ট্যাক্সি। ছোট একটা ব্রিজ-গ্যারেজের সঙ্গে রাস্তার যোগাযোগ রেখেছে। নিচে ঢালের গায়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রফেসর উইলসনের বাংলো।
সরু রাস্তা, বলল ড্রাইভার। সামনের দিক থেকে কোন গাড়ি এলে মোড় ঘোরার আগে দেখতে পাবে না। লাগিয়ে বসতে পারে আমার ট্যাক্সিতে। আপনারা যান। পাহাড়ের নিচে একটা পার্কিং লট আছে। ওখানে অপেক্ষা করব আমি।
গাড়ি থেকে নামলেন প্রফেসর বেনজামিন, রবিন আর কিশোর। ব্রিজ পেরিয়ে দেখল, গ্যারেজের একপাশ থেকে নেমে গেছে সিঁড়ি।
সিঁড়ি বেয়ে নেমে সদর দরজায় গিয়ে দাঁড়াল ওরা। বেল বাজালেন প্রফেসর।
দরজা খুলে দিল উইলসন। আরে, প্রফেসর! আসুন, আসুন। মধ্যপ্রাচ্যের প্রাচীন ভাষা নিয়ে ডিকশনারি লিখছি, ঠিক সময়েই এসে পড়েছেন। তো, এই অসময়ে কি মনে করে?
জানালেন প্রফেসর বেনজামিন।
খুব উত্তেজিত মনে হল উইলসনকে। অবিশ্বাস্য! এখনই শুনব ক্যাসেটটা! বুড়ো মিয়া কি বলছে বোঝা দরকার।
পথ দেখিয়ে মেহমানদেরকে স্টাডিতে নিয়ে এলেন উইলসন। বইয়ে প্রায় বোঝাই হয়ে গেছে ঘরটা। আর আছে কয়েকটা রেকর্ড প্লেয়ার, টেপ-রেকর্ডার। ক্যাসেটটা নিয়ে একটা মেশিনে ঢুকিয়ে চালু করে দিলেন তিনি।
রা-অরকনের ফিসফিসে গলার আওয়াজ অনেক গুণ পরিবর্ধিত করে সারা ঘরে ছড়িয়ে দিল যেন স্পীকার। শুনতে শুনতে হতাশা ফুটল উইলসনের চেহারায়। উত্তেজনা চলে গেছে। দুঃখিত, প্রফেসর, একটা শব্দও বোঝা যাচ্ছে না। রেকর্ডিং খুব খারাপ, আসল শব্দের চেয়ে মেশিনের শব্দই বেশি ক্যাচ করেছে। আরেকটা মেশিন আছে আমার। ফালতু আওয়াজ কমিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা আছে ওটাতে। দেখি। ওটাতে লাগিয়ে। কাজ হতেও পারে।
বেরিয়ে গেলেন উইলসন। ফিরে এলেন ছোট একটা টেপ-রেকর্ডার সেট নিয়ে। ক্যাসেটটা আগের মেশিন থেকে বের করে নিয়ে নতুনটাতে ভরলেন। টিপে দিলেন প্লে লেখা বোতাম।
.
কাজ সারতে খুব একটা দেরি হল না মুসার। প্রফেসর বেনজামিনের ওখান থেকে একবার ঘুরে আসার সিদ্ধান্ত নিল। সেকথা বলল বোরিসকে।
প্রফেসর বেনজামিনের বাড়িতে যখন পৌঁছল ট্রাক, অন্ধকার হয়ে গেছে তখন। একটা মাত্র আলো দেখা যাচ্ছে এত বড় বাড়িটাতে।
মনে হচ্ছে বাড়িতে কেউ নেই, বলল বোরিস। যাবে?
কেউ না থাকলেও প্রফেসরের খানসামা থাকবেই, বলল মুসা। নেমে পড়ল। ট্রাক থেকে। ওর কাছেই জানতে পারব কে কোথায় গেছে, যদি গিয়ে থাকে।
হাতঘড়ি দেখল বোরিস। তাড়াতাড়ি এস। রোভারকে নিয়ে সিনেমায় যাব। ও অপেক্ষা করবে। পাঁচ মিনিটের মধ্যে আসতে পারবে?
আপনি চলে যান তাহলে, বলল মুসা। কত দেরি হবে, ঠিক বলতে পারছি না। পাহাড়ের নিচে ট্যাক্সি স্ট্যাণ্ড দেখলাম। বাড়ি ফিরতে অসুবিধা হবে না।
ঠিক আছে, ইঞ্জিন স্টার্ট দিল বোরিস। চলে গেল ট্রাক নিয়ে।
বাড়ির সদর দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল মুসা। বেল বাজাল। অপেক্ষা করছে দরজা খোলার। মিসেস ভেরা চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের কথা ভাবছে।
দ্রুত কথা বললেন মহিলা। অনেক কথাই বলে ফেলেছেন খুব কম সময়ে। হপ্তাখানেক আগে হারিয়ে গেছে তার শখের বেড়ালটা। খুব সুন্দর দেখতে। এ অঞ্চলে দুষ্প্রাপ্য। বেশির ভাগ আবিসিনিয়ান বেড়ালই বুনো স্বভাবের, পোষ মানে, তবে মনিবের সঙ্গেও ব্যবহার খারাপ করে। কিন্তু ওই বিশেষ বেড়ালটা ছিল ঠিক উল্টো। ভদ্র, কোনরকম বাজে স্বভাব ছিল না। মিসেস চ্যানেলের ধারণা, হয় বেড়ালটাকে চুরি করা হয়েছে, কিংবা বাড়ি থেকে দূরে কোথাও চলে গিয়েছিল, পথ। চিনে আর ফিরতে পারেনি।
বেড়ালটা পিঙ্গল রঙের, শুধু সামনের দুই পায়ের নিচের অংশ সাদা। চোখ দুটোতে আশ্চর্য একটা বৈসাদৃশ্য রয়েছে। আবিসিনিয়ায় বেড়ালের চোখ সাধারণত হলুদ কিংবা কমলা রঙের হয়। অথচ স্ফিঙ্কসের একটা চোখ কমলা, আরেকটা নীল। এই বিশেষ ব্যাপারটার জন্যে কয়েকবারই বেড়ালের মেলায় ওটাকে নিয়ে গেছেন। মিসেস চ্যানেল। দেখিয়ে লোককে অবাক করে দেয়ার জন্যে। স্থানীয় অনেক পত্র পত্রিকা আর ম্যাগাজিনে বেরিয়েছেও খবরটা ফিঙ্কসের রঙিন ফটোগ্রাফসহ। জীববিজ্ঞানীদের মতে বেড়ালের চোখের রঙের সেই বৈসাদৃশ্য খুব বিরল একটা ব্যাপার।