ভাল অভিনেতা কিশোর। গলার স্বরও পুরোপুরি নকল করেছে। প্রফেসরের কোট আর টাই পরেছে। শার্টের তলায় আলগা কাপড় তোয়ালে দিয়ে বেঁধে ভুড়ি তৈরি করেছে। খুব কাছে থেকে কেউ না দেখলে বুঝতেই পারবে না ব্যাপারটা। চোখ বন্ধ রেখে রা-অরকনের মমি নিশ্চয় ধরতে পারবে না এই ফাঁকি, আশা করছে কিশোর।
রবিন আর প্রফেসর বেনজামিন অপেক্ষা করছেন পাশের ঘরে। হুপার রান্নাঘরে। ব্যস্ত। কি ঘটছে না ঘটছে, কিছুই জানে না। নীরব রয়েছে মমি।
মহান রা-অরকন, আবার বলল কিশোর, কথা বলুন। আমি বোঝার চেষ্টা করব।
কি যেন শোনা গেল? মাথা কাত করে মমির ঠোঁটের কাছে কান নিয়ে এল। কিশোর। অদ্ভুত খসখসে কণ্ঠস্বর। হিসহিস আর ফিসফিসানিতে ভরা। আরও কিছু অদ্ভুত শব্দ মিশেছে। শব্দগুলো বোঝাই মুশকিল।
অবাক হয়ে পুরো ঘরে চোখ বোলাল কিশোর। একা রয়েছে সে। দরজা বন্ধ। ফিসফিস করে বলেই চলেছে রা-অরকন। কান পেতে আছে কিশোর। কেমন এক ধরনের আদেশের সুর রয়েছে বলার ভঙ্গিতে। কিন্তু একটা শব্দও বুঝতে পারছে না সে।
কোটের নিচে কোমরের বেল্টের সঙ্গে আটকানো রয়েছে একটা পোর্টেবল টেপ রেকর্ডার। খুলে নিয়ে ওটা মমির ঠোঁটের কাছাকাছি রাখল কিশোর। রেকর্ডিং সুইচ। টিপে দিয়েছে।
রা-অরকন, আপনার কথা বুঝতে পারছি না, জোরে বলল কিশোর। আরেকটু জোরে বলুন।
ক্ষণিকের জন্যে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কথা, আবার শুরু হল। অনর্গল উচ্চারিত হচ্ছে কিছু দুর্বোধ্য শব্দ, নানারকম আওয়াজের মাঝে বোঝাই কঠিন। টেপ রেকর্ডারের মাইক্রোফোন কথা ধরতে পারবে তো?–সন্দেহ হচ্ছে কিশোরের।
মিনিটখানেক ধরে একটানা কথা বলে যাচ্ছে রা-অরকন। ভাল করে শোনার জন্যে কান মমির ঠোঁটের কাছে নিয়ে গেল কিশোর। ক্ষণিকের জন্যে থামল কথা। সোজা হতে গেল সে। পুরানো কফিনের বেরিয়ে থাকা সুচালো একটা কাঠের ফলায় আটকে গেল দাড়ি। হ্যাঁচকা টানে খুলে গেল গাল থেকে। বেকায়দা ভঙ্গিতে ঝুঁকে থাবা দিয়ে ধরতে গেল দাড়ি। ভারসাম্য হারিয়ে দড়াম করে পড়ল মেঝেতে। নাকের ওপর থেকে খসে পড়ে গেল চশমা, উইগ খুলে চলে এল চোখের ওপর। নিজের অজান্তেই একটা চিৎকার বেরিয়ে এল মুখ থেকে।
অন্ধের মত উঠে দাঁড়াল কিশোর। চুলদাড়ি আবার জায়গামত লাগানর চেষ্টা চালাচ্ছে দ্রুত হাতে।
এই সময় ঝটকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। হুড়মুড় করে ঘরে এসে ঢুকল রবিন আর প্রফেসর।
কিশোর, কি হয়েছে? রবিন উদ্বিগ্ন।
তোমার চিৎকার শুনলাম! বলে উঠলেন প্রফেসর। কিছু হয়েছে?
আমার অসাবধানতা, তিক্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। বোধহয় সব ভজকট করে দিয়েছি! মমি কথা বলছিল…
বোকা বানিয়েছ তাহলে! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
জানি না কি করেছি! কথা তো বলেছিল! দেখি, আবার বলে কিনা! আবার মমির ওপর ঝুঁকল কিশোর। রা-অরকন, বলুন। রা-অরকন? অপেক্ষা করছে। তিনজনে। মমি নীরব। নিজেদের শ্বাস ফেলার শব্দ শুনতে পাচ্ছে ও নিস্তব্ধ ঘরে।
লাভ নেই, অবশেষে বলল কিশোর। আর এখন কথা বলবে না মমি। দেখি, টেপে রেকর্ড হয়েছে কিনা। _ যন্ত্রটা তুলে নিয়ে দরজার দিকে এগোল গোয়েন্দাপ্রধান। পেছনে এগোল রবিন আর প্রফেসর। পাশের ঘরে চলে এল।
টেপ-রেকর্ডারটা টেবিলে রাখল কিশোর। গা থেকে কোট খুলে ফেলল। খুলল পেটে বাঁধা কাপড়। তারপর টেপ রিউইও করে নিয়ে প্লে লেখা বোতাম টিপে দিল।
কয়েক মুহূর্ত শুধু স্পীকারের মৃদু হিসহিস শব্দ। তারপরেই শোনা গেল কথা। খুবই মৃদু। বোঝাই যায় না প্রায়। ভলিউম বাড়িয়ে দিলে স্পীকারের শব্দও বেড়ে যায়। আরও বোঝা যায় না কথা।
শেষ হল মমির কথা। কিশোরের চিৎকারটা শোনা যেতেই সুইচ অফ করে দিল সে। প্রফেসরের দিকে তাকাল। কিছু বুঝতে পেরেছেন, স্যার?
নীরবে মাথা নাড়লেন প্রফেসর। তারপর বললেন, একআধটা শব্দ পরিচিত মনে হচ্ছে, তবে মানে বুঝতে পারছি না। মধ্যপ্রাচ্যের ভাষা, সন্দেহ নেই, খুবই প্রাচীন। সারা ক্যালিফোর্নিয়ায় একজন লোকই আছে, যে হয়ত এর মানে উদ্ধার করতে পারবে। সে প্রফেসর জিম উইলসন, আমার সহকারীর ছেলে। হাত তুলে জানালা দিয়ে প্রফেসর উইলসনের বাড়িটা দেখালেন। দেখা যাচ্ছে, কাছে। আসলেও তাই। তবে সরাসরি যাওয়ার পথ নেই, পাহাড় ঘুরে যেতে হয়। ট্যাক্সিতে করে গেলে পাঁচ-সাত মিনিটের বেশি লাগবে না। ওকে আগেই বলেছি মমিটার কথা। আমাকে সাহায্য করবে বলে কথাও দিয়েছে। চল, টেপটা নিয়ে এখুনি তার কাছে চলে যাই।
কিশোর রাজি।
হুপারকে ডাকলেন প্রফেসর। সে এলে বললেন, হুপার, আমরা জিমের বাড়িতে যাচ্ছি। তুমি থাক। কড়া নজর রাখবে চারদিকে। তেমন সন্দেহজনক কিছু দেখলে সঙ্গে সঙ্গে ফোন করবে আমাকে।
ঠিক আছে, স্যার।
মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই তৈরি হয়ে প্রফেসর উইলসনের বাড়ির দিকে রওনা হল তিনজনে। বিশাল বাড়িটায় একা হুপার। রান্নাঘরে গিয়ে ঢুকল সে। কয়েকটা প্লেট মাজছিল, শেষ হয়নি মাজা। আবার কাজে মন দিল।
বাইরে অন্ধকার নামছে। প্লেট মাজতে মাজতেই অস্পষ্ট একটা শব্দ শুনতে পেল হুপার। থমকে গেল। কান পাতল।
কিন্তু আর শোনা গেল না শব্দটা। সন্দেহ গেল না হুপারের। হাতের বাসনটা নামিয়ে রেখে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল। প্রফেসরের সংগ্রহ থেকে প্রাচীন এক বিশাল তলোয়ার তুলে নিয়ে পা টিপে এগোল জাদুঘরের দিকে।