শুনেছি, এবং বুঝতে পেরেছি, স্পীকারের সুইচ অফ করে দিল মুসা।
পেরিস্কোপ নামাতে এগিয়ে গেছে রবিন। বাজ পাখির চোখ! কিছু এড়ায় না। নামার আগে একবার চোখ রাখল পেরিস্কোপের আয়নায়। গেটের কাছে থেমেছে ট্যাক্সি। কিশোর বেরিয়ে এসেছে। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ। হাঁটতে শুরু করেছে। ট্যাক্সিটা অপেক্ষা করছে। পেরিস্কোপ নামিয়ে আগের চেয়ারে এসে বসল রবিন। গিয়েছিল কোথায়!
নীরব রইল মুসা। জবাবটা সে নিজেও জানে না।
এক মিনিট পেরোল-দুই-তিন-চার-পাঁচ।…দশ মিনিট পেরোল…পনেরো…
আসছে না কেন এখনও! বলল রবিন। এতক্ষণে তো এসে পড়ার… ট্রেলারের মেঝেতে ট্র্যাপডোরের শব্দ শুনে থেমে গেল।
খুলে গেল বোর্ডটা। একটা মাথা দেখা দিল সুড়ঙ্গের মুখে। একজন বৃদ্ধ মানুষ। কাঁচাপাকা ঘন ভুরু। চোখে সোনার ফ্রেমের চশমা। মুখে দাড়ি।
প্রফেসর বেনজামিন! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। আপনি এখানে এলেন কি করে? কিশোর কোথায়?
রা-অরকনের অভিশাপ নেমেছে তার ওপর, খুদে অফিস ঘরটায় উঠে এলেন প্রফেসর। রা-অরকন সব উল্টে দিয়েছে। প্রফেসরকে কিশোর আর কিশোরকে প্রফেসর বেনজামিন বানিয়েছে। টেনে মাথার সাদা উইগ খুলে ফেলল কিশোর। চশমা খুলে দরাজ হাসি হাসল দুই বন্ধুর দিকে চেয়ে। তোমাদেরকে যখন বোকা। বানাতে পেরেছি, মমিটাকে নিশ্চয়ই পারব।
হাঁ করে আছে রবিন। চোখ বড় বড়।
খাইছে, কিশোর! মুসার চোখও কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে যেন। দারুণ হয়েছে ছদ্মবেশ। আমরাই গাধা বনে গেছি। মমিটাকে বোকা বানানর কথা। কি যেন বলছিলে?
পরীক্ষা নেব, কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে উইগ আর চশমাটা ভরে ফেলল কিশোর। দাড়িটা টেনে খুলে নিয়ে ভরল। কপালে, চোখের পাতায় বিশেষ রঙিন। পেন্সিলে কয়েকটা দাগ টানা হয়েছে। মাত্র কয়েকটা দাগেই অনেক বয়স্ক দেখাচ্ছে। তাকে। মি. ক্রিস্টোফারের কাছে গিয়েছিলাম। একজন মেকআপ ম্যানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন তিনি। ছদ্মবেশের এই উপকরণ সেই মেকআপ ম্যানই দিয়েছে। কি করে ছদ্মবেশ নিতে হবে, শিখিয়ে দিয়েছে।
কিন্তু কেন? জিজ্ঞেস করল রবিন
মমিটাকে বোকা বানাতে, বলল কিশোর।
সে তো বলেছ! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। কেন বানাবে, সেটাই জানতে চাইছি।
আমাকে প্রফেসর বেনজামিন বলে ভুল করলে, কথা বলবে, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর। তাই ছদ্মবেশ নিতেই হচ্ছে। আর কারও সঙ্গে তো কথা বলে না ওটা।
আল্লাই জানে কি বলছ! এমনভাবে বলছ, যেন মমিটা দেখতে পায়, শুনতে পায়, চিন্তা করতে পারে! কিশোর, ওটা একটা মমি। তিন হাজার বছর আগে মারা যাওয়া একটা মানুষের শুকনো লাশ। ওটা কথা বলে! এবার সত্যিই বুঝি ভূতের পাল্লায় পড়লাম! কিশোর, এখনও সময় আছে। ভাল চাও তো, ভুলে যাও ওটার কথা। চল, বেড়ালটার ব্যাপারে তদন্ত করি আমরা। মমি-রহস্যের সমাধান করতে পারব না। খামোকা বেঘোরে প্রাণটা হারাব।
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল রবিন। ঢোক গিলল। নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর।
তার মানে, মুসার দিকে সরাসরি তাকিয়ে আছে কিশোর, তুমি আমাদের সঙ্গে যেতে চাও না? মমিটার কথা বলা শুনতে চাও না?
দ্বিধা করছে মুসা। উত্তেজিত হয়ে অনেক বেশি কথা বলে ফেলেছে, অনুশোচনা শুরু হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আস্তে মাথা নাড়ল সে। তাই বলতে চাইছি। কিশোর, এবার হয়ত জাদুঘরের ছাদটাই ভেঙে পড়বে আমাদের মাথায়! সকালে বড় বেশি নাছোড়বান্দা মনে হয়েছে রা অরকনকে।
বেশ, বলল কিশোর, আমরা মানুষ তিনজন। একই সঙ্গে একটা কাজ করতে হবে, তার কোন মানে নেই। তুমি প্রফেসরের ওখানে যেতে না চাইলে জোর করব না। মিসেস ভেরা চ্যানেলের ওখানেই যাও। বেড়ালটা সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে এস। আমি আর রবিন যাচ্ছি প্রফেসরের ওখানে। কি বল, রবিন?
রবিনও ভয় পাচ্ছে যেতে। তবে প্রচণ্ড কৌতূহলের কাছে হার মানল ভয়। মাথা কাত করল সে, যাবে।
বেশ, মুসার দিকে ফিরল কিশোর। আমরা ট্যাক্সি নিয়ে যাচ্ছি। তুমি ইয়ার্ডের পিকআপটায় করে যাও। দেখলাম, বসে আছে বোরিস। তেমন কাজকর্ম নেই। বললে তোমার সঙ্গে যেতে রাজি হয়ে যেতে পারে ও।
দ্বিধা যাচ্ছে না মুসার। অবশেষে মনস্থির করে নিয়ে বলল, ঠিক আছে তাই যাব। সুড়ঙ্গমুখের দিকে এগিয়ে গেল।
দুই সুড়ঙ্গ দিয়ে বেরিয়ে এল মুসা। অফিসে তালা লাগাচ্ছে বোরিস। মুসাকে দেখে হাসল।
এক কথায় রাজি হয়ে গেল বোরিস। মুসাকে নিয়ে যাবে সান্তা মনিকায়।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করল মুসা, কিশোরকে দেখিয়ে দেবে এবার, গোয়েন্দাগিরিতে সে-ও কম যায় না। বেড়ালটা খুঁজে বের করবেই সে। কিন্তু খচখচও করছে মনের ভেতর, দুই বন্ধুর জন্যে। রা-অরকনের অভিশাপ যদি সত্যিই নেমে আসে কিশোর আর রবিনের ওপর?
.
০৭.
জাদুঘরে একা ঢুকল কিশোর। মাথার ওপরের আলোটা জ্বেলে দিল। বাইরে এখনও দিন। সূর্য অস্ত যায়নি, তবে খাড়া পাহাড়গুলোর আড়ালে চলে গেছে। ফলে অন্ধকার নেমে এসেছে গিরিখাতে। গাঢ় ছায়া গিলে নিয়েছে যেন বিশাল পুরানো বাড়িটাকে।
বুড়ো মানুষের মত ধীরে সুস্থে নড়াচড়া করছে কিশোর, অবিকল প্রফেসর বেনজামিনের নকল। বড় জানালাগুলো খুলে দিল। তারপর গিয়ে দাঁড়াল কফিনটার সামনে। ঢাকনা তুলে দাঁড় করিয়ে রাখল একপাশে। একনজর দেখল মমিটাকে। ঝুঁকল ওটার ওপর। জোরে জোরে বলল, রা-অরকন, কথা বলুন। আমি শুনছি।