আবার চাওয়া-চাওয়ি করল মুসা আর রবিন। ব্যাপারটাকে আধিভৌতিক বলে মেনে নিতে আর কোন দ্বিধা নেই ওদের।
তবে দুজনের মনে হল, গভীর রহস্যের সন্ধান পাওয়ায় খুশি খুশি লাগছে যেন কিশোরকে।
এখন, বললেন প্রফেসর। ওসব ফালতু চিন্তা বাদ দিয়ে এস দেখি, কেন। খসে পড়ল বলটা। কারণটা জানার চেষ্টা করি।
গেটের দিকে এগোলেন প্রফেসর। পেছনে তিন গোয়েন্দা, সবার পেছনে হুপার।
থামের মাথায় সুড়কি দিয়ে একটা খাজ বানানো হয়েছিল, তার ওপর বসান ছিল বলটা। আটকে দেয়া হয়েছিল সিমেন্ট দিয়ে। দীর্ঘদিন রোদ বাতাস আর বৃষ্টিতে ক্ষয়ে গিয়েছে সিমেন্ট। খাজের একটা দিক ভাঙা, ফলে বলটা পড়ে গেছে।
কোন রহস্য নেই, বললেন প্রফেসর। সিমেন্ট আর সুড়কি ক্ষয় হয়ে গেছে, ওই দেখ রিং ভাঙা। ঢালের দিকে সামান্য কাত হয়ে আছে থাম। হয়ত, অতি মৃদু ভূমিকম্প হয়েছিল, এতই মৃদু আমরা টের পাইনি। এটা নতুন কিছু না এ অঞ্চলে। মাঝেমধ্যেই এরকম ঘটে।
প্রফেসরের যুক্তি মনঃপূত হল না হুপারের। ধীরে ধীরে মাথা নেড়ে সেখান থেকে চলে গেল সে।
প্রফেসরের সঙ্গে সঙ্গে চত্বরে এসে উঠল আবার তিন গোয়েন্দা। জাদুঘরে ঢুকল। ঘিরে দাঁড়াল রা-অরকনের মমিকে।
বুদ্ধি আছে তোমার, কিশোরের প্রশংসা করলেন প্রফেসর। মরা মমি কি করে কথা বলে, একটা যুক্তি দেখাতে পেরেছ। তবে ভুল যুক্তি। কারণ, কফিনের কোথাও কোন রেডিও লুকানো নেই।
ভালমত দেখেছিলেন তো, স্যার?।
চোখ মিটমিট করলেন প্রফেসর। নিশ্চয়। বেশ, তোমাদের সামনেই আবার দেখছি। মমিটা কফিন থেকে বের করে নিলেন তিনি। কিশোরকে খুঁজে দেখতে বললেন।
না, নেই রেডিও।
এবার সত্যিই বিস্মিত হল কিশোর। নাহ্, নেই! ইলেকট্রনিক কোন কিছুই নেই। প্রফেসর, আমার প্রথম যুক্তি ভুল হল।
প্রথম যুক্তি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুল হয়, কিশোরকে উৎসাহ দিলেন প্রফেসর। তবে পরের যুক্তিটা হয়ত ঠিক হবে। ভেবে বের করে ফেল আরেকটা কিছু।
আপাতত পারছি না, স্যার। আচ্ছা, বললেন, শুধু যখন আপনি একা থাকেন। এঘরে, তখনই মমিটা কথা বলে।
হ্যাঁ, মাথা ঝোঁকালেন প্রফেসর। আর বলে বিশেষ একটা সময়ে। শেষ বিকেল কিংবা সন্ধ্যায়।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। এ-বাড়িতে আপনি ছাড়া আর কে কে থাকে?
হুপার। দশ বছর ধরে আমার চাকরি করছে সে। তার আগে থিয়েটারে কাজ করত, অভিনেতা। সে আমার শোফার, বাবুর্চি, খানসামা। হপ্তায় তিন দিন একজন মহিলা আসে ঘরদোর পরিষ্কার করতে, তবে ও থাকে না এখানে।
মালীর ব্যাপারটা কি? নতুন?
তা জানি না, মাথা নাড়লেন প্রফেসর। আট বছর ধরে রিগো কোম্পানির লোক দিয়ে কাজ করাচ্ছি। একেকবার একেকজন লোক আসে। সবার চেহারা মনে রাখা সম্ভব না। তবে বাগান পর্যন্তই ওদের সীমানা। কখনও বাড়ির ভেতরে ঢোকে না।
হুমম! চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা ঝোঁকাল কিশোর। ভুরু কুচকে গেছে। যা-ই হোক, মমিটার কথা-বলা নিজের কানে শুনতে হবে আমাকে।
কিন্তু ও তো শুধু আমার সঙ্গে কথা বলে। হুপার কিংবা জিমের সঙ্গে বলেনি। তোমার সঙ্গে বলবে বলেও মনে হয় না।
হ্যাঁ, প্রফেসরের সঙ্গে একমত হল রবিন। তোমার সঙ্গে কেন কথা বলতে যাবে মমিটা? তুমি তো ওর কাছে অপরিচিত।
এক মিনিট, হাত তুলল মুসা। কথাবার্তা মোটেই সুবিধার মনে হচ্ছে না আমার। এমনভাবে বলা হচ্ছে, যেন মমিটা সব কথা শুনতে পাচ্ছে, সব বুঝতে পারছে। ও যেন আমাদের মতই জ্যান্ত!
ঠিকই বলেছ, সায় দিলেন প্রফেসর। এসব আলোচনার কোন মানে নেই। বৈজ্ঞানিক কোন যুক্তি পাওয়া যাচ্ছে না।
কারও কথায়ই কান দিল না কিশোর। দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করল, আমার বিশ্বাস, মমিটা আমার সঙ্গে কথা বলকে। একবার কথা বললেই আরও কিছু তথ্য জোগাড় করে ফেলতে পারব আমি। প্রফেসর, বিকেলে আবার আসব আমরা। পরীক্ষা চালাব।
.
ইয়াল্লা, কিশোর কোথায়? হেডকোয়ার্টারের দেয়ালে লাগানো ঘড়িটার দিকে চেয়ে আছে মুসা। আমাদেরকে ছটায় আসতে বলে সে নিজেই গায়েব। সোয়া ছটার বেশি বাজে।
মেরিচাচীকে জিজ্ঞেস করে এস, সকালের ঘটনার রিপোর্ট লিখছে রবিন। তিনি হয়ত কিছু বলতে পারবেন।
এসেই জিজ্ঞেস করছি, বলল মুসা। তিনি কিছু জানেন না। বলে যায়নি কিশোর। দেখি এসেছে কিনা ও। উঠে গিয়ে পেরিস্কোপে চোখ রাখল। হাতল ধরে ঘোরাল এদিক-ওদিক। চেঁচিয়ে উঠল হঠাৎ, ওই যে, এসে গেছে। শহরের দিক থেকে আসছে। ট্যাক্সিতে করে। জানালা দিয়ে মুখ বের করে দিয়েছে। হয়ত ওয়াকি-টকিতে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে।
দ্রুত ডেস্কের কাছে চলে এল মুসা। এক কোণে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে একটা লাউড-স্পীকার, বাক্সে ভরে। টেলিফোন লাইনের সঙ্গে যোগাযোগ রয়েছে ওটার। মুসা কিংবা রবিন জানত না, গত হপ্তায় ওটার ওপর আরেক দফা কারিগরী চালিয়েছে কিশোর। বাক্সের মধ্যে একটা রেডিও সেট বসিয়ে যোগ করে দিয়েছে মাইক্রোফোন আর স্পীকারের সঙ্গে। সুইচ অন করা থাকলে হেডকোয়ার্টারের ভেতরের সব আওয়াজ ট্রান্সমিট করে ওটা। প্রফেসর বেনজামিনের ওখান থেকে এসে কথাটা দুই বন্ধুকে জানিয়েছে কিশোর।
বাক্সটার দিকে চেয়ে মুখ বাঁকাল মুসা। এহ, মাইণ্ড রিডিং! সকালে কি ফাঁকিটাই না দিয়েছে আমাদের। আমরা কি বলছি সব শুনেছে! বিড়বিড় করতে করতে বাক্সের সামনে মুখ নিয়ে এল সে। একটা সুইচ অন করল। হেডকোয়ার্টার থেকে বলছি। সেকেণ্ড কলিং ফাস্ট। সেকেণ্ড কলিং ফাস্ট। সুইচটা অফ করে টিপে আরেকটা সুইচ অন করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে গুঞ্জন উঠল স্পীকারে। তারপরই পরিষ্কার ভেসে এল কিশোরের গলা। ফার্স্ট বলছি। শিগগিরই আসছি। সর্ব দর্শন তুলে দিয়েছ কেন? নামাও। দরকারের সময় ছাড়া একদম তুলবে না ওটা। গোপনীয়তা ফাঁস হয়ে যেতে পারে। ওভার অ্যাণ্ড আউট।