ঘুরে দাঁড়াল মালী। মাথা নিচু করে হাঁটতে শুরু করল বাড়ির দিকে।
লোকটা রিগো কোম্পানিতে কাজ করে, কিশোরের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে বললেন প্রফেসর। বাগানের কাজের চুক্তি নেয় কোম্পানিটা। খুব ভাল ভাল মালী আছে ওদের। দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার অনেকেই নিয়মিত ডাকে।
এখনও হাঁফাচ্ছে মুসা। হায়-হায়রে! খামোকাই কষ্ট করলাম! ব্যাটা ছেড়ে দেবে জানলে আমিই ধরে রাখতাম!
কিন্তু ছেলেটা কে? জিজ্ঞেস করল রবিন। কি করছিল এখানে?
ঝোপে বসে প্রফেসরের বাড়ির দিকে চোখ রাখছিল, বলল মুসা। নড়েচড়ে উঠেছিল, তাই দেখে ফেলেছিলাম।
অনেক কিছু জানাতে পারত সে আমাদেরকে! নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর।
ছেলেরা, বললেন প্রফেসর। ব্যাপার-স্যাপার ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে..
তিন জোড়া চোখ ঘুরে গেল তার দিকে।
..তবে, মুসার চিল্কারের পর পরই কয়েকটা শব্দ কানে এসেছে। বোধহয় ছেলেটাই বলেছে।
কিছুই বুঝিনি, বলল মুসা। বিদেশী ভাষা।
আধুনিক, আরবী, বললেন প্রফেসর। কি বলেছে জান? বলেছে: হে মহান রা-অরকন, দয়া করে সাহায্য করুন আমাকে!
কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলল কিশোর, থেমে গেল মুসার চিঙ্কারে, হুশিয়ার! হাত তুলে নির্দেশ করছে একটা দিক।
নিমেষে সবকটা চোখ ঘুরে গেল সেদিকে।
বড় গেটটার দুপাশে দুটো মোটা থাম, মাথায় বসানো দুটো এ্যানেটের বিশাল বল। কি করে জানি খসে পড়ে গেছে একটা। বিপজ্জনক গতিতে ঢাল বেয়ে গড়িয়ে নেমে আসছে ওদের দিকে। গতি বাড়ছে প্রতি মুহূর্তে।
০৬.
ছুট লাগানর জন্যে তৈরি হয়েছে রবিন আর মুসা। থেমে গেল প্রফেসরের তীক্ষ্ণ চিৎকারে। খবরদার! এক চুল নড়বে না কেউ।
প্রফেসর বেনজামিনের প্রতি কিশোরের শ্রদ্ধা বাড়ল। বিপদের সময় মাথা ঠাণ্ডা রাখার অদ্ভুত ক্ষমতা তাঁর, কড়া নজর। তার আগেই প্রফেসর অবস্থাটা মনে মনে জরিপ করে নিয়েছেন। বলটা ওদের গায়ে পড়বে না, চলে যাবে পাশ দিয়ে।
লাফিয়ে গড়িয়ে ওদের দশ ফুট দূর দিয়ে চলে গেল বলটা। নিচের কয়েকটা ইউক্যালিপটাস গাছে গিয়ে ধাক্কা খেল প্রচণ্ড শব্দে।
সেরেছিল। কপালের ঘাম মুছল রবিন। ওদিকেই রওনা হয়েছিলাম আমি, ভর্তা হয়ে যেতাম!
আমি হতাম না, বলল মুসা। উল্টো দিকে লক্ষ্য ছিল আমার। ওজন কত হবে? এক টন?
বেশি হবে, বললেন প্রফেসর। গ্র্যানেটের বল, এক ঘন-ফুটে ওজন। হবে…দাঁড়াও, অঙ্ক কষে…
প্রফেসর!
কথা থামিয়ে ফিরলেন প্রফেসর। অন্য তিনজনও তাকাল। হুপার ছুটে আসছে।
কাছে এসে দাঁড়াল হুপার। হাঁপাচ্ছে। রান্নাঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে ছিলাম। দেখেছি! কোন ক্ষতি হয়নি তো আপনাদের?
না, কোন ক্ষতি হয়নি, অস্থির কণ্ঠস্বর। হুপারের দিকে চেয়ে ঘন ভুরুজোড়া কোঁচকালেন প্রফেসর। কি বলবে, জানি। শুনতে চাই না ওসব আর!
মাফ করবেন স্যার, তবু বলল হুপার, এটা রা-অরকনের অভিশাপ ছাড়া আর কিছু না! একের পর এক দুর্ঘটনা-রা-অরকন আপনাকে খুন করবে, স্যার! হয়ত আমাদের সবাইকেই করবে!
রা-অরকনের অভিশাপ! বিড়বিড় করল কিশোর। প্রফেসরের দিকে ফিরল, প্রফেসর, মমিটা যে কবরে পেয়েছেন, ওখানে কি কোন কিছুতে অভিশাপের কথা লেখা ছিল?
না, মানে—ইয়ে—হ্যা..
প্রফেসরের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলল হুপার, ছিল! লেখা ছিল: যে এই কবরের পবিত্রতা আর শান্তি বিনষ্ট করবে, তার ওপর নেমে আসবে রা-অরকনের অভিশাপ! কবর খোঁড়ার কাজে যারা সহায়তা করেছিল, তাদের অনেকেই মরেছে। সাতজন..।
হুপার! গর্জে উঠলেন প্রফেসর। খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছ!
মাফ করবেন, স্যার, দুঃখিত, চুপ হয়ে গেল খানসামা।
লজ্জিত হলেন প্রফেসর। কিশোরের দিকে চেয়ে বললেন, একেবারে মিথ্যে বলেনি হুপার। রা-অরকনকে ঘিরে সত্যিই কিছু রহস্য গড়ে উঠেছে। একটা পাথরের পাহাড়ের চূড়ার কাছে ছিল ওর কবর। কবরটা লুকানো ছিল ভালমত। রাজকীয় কবর, অথচ মূল্যবান কিছু পাওয়া যায়নি সমাধিকক্ষে। শুধু সাধারণ একটা কফিনে রা-অরকন আর তার আদরের পোষা বেড়ালটার মমি। তবে, ও রা অরকন কিনা, তাতেও যথেষ্ট সন্দেহ আছে। শুধু কফিনের গায়ে ছাড়া কবরটার আর কোথাও তার নাম লেখা নেই, ফারাওদের কোন চিহ্ন নেই। যদি সে রা-অরকন হয়ে থাকে, তাহলে বিশেষ কোন কারণে ওরকম সাধারণভাবে কবর দেয়া হয়েছিল। তাকে। সমাধিকক্ষটা দেখে যা মনে হয়েছে, প্রাচীন দস্যু-তস্করেরা ঢুকতে পারেনি ওখানে। আর যদি ঢুকে থাকে, তাহলে নিশ্চয়ই খুব হতাশ হতে হয়েছিল। তাদেরকে। কিছু পায়নি।
অভিশাপের কথা কোথায় লেখা ছিল? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
কয়েকটা মাটির ফলক পাওয়া গিয়েছে, তাতে। মমিটা কবর থেকে বের করে আনার পরের দিনই মোেটর দুর্ঘটনায় মারা গেছে আমার প্রধান সহকারী! তার পরের দিন কায়রোর বাজারে খুন হল আমার সেক্রেটারি। একই জায়গায় প্রায় একই সময় খুন হল আরও একজন। সে-ও আমার সহকারী ছিল, বন্ধুও। জিম উইলসনের বাবা। যে শ্রমিকেরা খুঁড়েছিল, তাদের ওভারশিয়ার। মারা গেল সাপের কামড়ে। সবকটাই দুর্ঘটনা! এর মধ্যে কোন রহস্য নেই। মোটর দুর্ঘটনা, খুনখারাপি, কিংবা সাপের কামড় নতুন কোন ঘটনা নয়।
চাওয়া-চাওয়ি করল মুসা আর রবিন। ব্যাপারটাকে আধিভৌতিক বলেই মনে হচ্ছে ওদের।
ও হ্যাঁ, আরেকটা কথা, অভিশাপের সঙ্গে এর কোন সম্পর্ক নেই, বললেন। প্রফেসর। যেদিন মমিটা আমার বাড়িতে এসে পৌঁছুল সেদিনই একজন লোক। এসেছিল দেখা করতে। অ্যারাবিয়ান। নাম, জলিল—কি যেন! মমিটা দিয়ে দিতে। বলল। বেশ চাপাচাপি করল আমাকে। লিবিয়ার এক ধনী ব্যবসায়ী পাঠিয়েছে তাকে। জলিল ওই লোকটার ম্যানেজার। রা-অরকন নাকি ওই ব্যবসায়ী জামানের পূর্বপুরুষ। সেটা জেনেছে আবার এক জাদুকরের কাছে। যত্তোসব ভোগলামি! প্রথমে ভদ্রভাবে বললাম, গেল না জলিল। শেষে, ব্যবহার খারাপ করতে বাধ্য হয়েছি। যাওয়ার আগে জলিল হুঁশিয়ার করে দিয়ে গেছে, রা-অরকনের প্রেতাত্মা নাকি ছাড়বে না আমাকে। মমিটাকে মিশরে নিয়ে গিয়ে যথাযোগ্য মর্যাদায় আবার কবর না দিলে অভিশাপ নামবে আরও অনেকের ওপর।