যাচ্ছি! জানালা পেরিয়ে চত্বরে নামল মুসা। কানের কাছে তুলে রেখেছে রেডিও।
প্রফেসর, বলল কিশোর, মমিটা চুলে কোন অসুবিধা হবে?
না, মাথা নাড়লেন প্রফেসর। তবে বেশি নাড়াচড়া কোরো না।
মমির ওপর ঝুঁকল কিশোর। পরমুহূর্তেই সোজা হয়ে দাঁড়াল। হাতে একটা। ওয়াকি-টকি, অন্যটা অদৃশ্য হয়ে গেছে। হাতেরটা মুখের কাছে এনে বলল, হ্যাঁ, এবার কথা শুরু কর, মুসা। প্রফেসর, শুনবেন। রবিন, তুমিও শোন।
সবাই কান খাড়া রাখল। নীরবতা। তারপর একটা মৃদু বিড়বিড় শোনা গেল।
মমির ওপর ঝুঁকে দাঁড়ান, প্রফেসরকে বলল কিশোর। কানের কাছে ধরা রয়েছে তার ওয়াকি-টকি।
ভ্রুকুটি করলেন প্রফেসর। ঝুঁকলেন মমির ওপর। রবিনও ঝুঁকল। ফিসফিসে কথা শোনা যাচ্ছে কফিনের ভেতর থেকে। দুজনের কারোই বুঝতে অসুবিধে হল না, ওটা মুসার কণ্ঠস্বর।
গেট পেরিয়ে এসেছি, বলল মুসা! ঢাল বেয়ে নেমে যাচ্ছি বড় ঝোঁপটার কাছে।
যেতে থাক, বলল কিশোর। ঘরের অন্য দুজনের দিকে ফিরল। দেখলেন তো, প্রফেসর, মমিকে কথা বলানো কত সহজ?
মমির ওপর ঝুঁকল কিশোর। আলগা লিনেনের নিচ থেকে বের করে আনল তৃতীয় ওয়াকি-টকিটা। ওটা থেকেই আসছে মুসার কণ্ঠস্বর। যেন মমিই কথা বলছে।
বৈজ্ঞানিক সমাধান, স্যার, প্রফেসরকে বলল কিশোর। মমির লিনেনে ছোট একটা রেডিও রিসিভার লুকিয়ে রাখা যায় সহজেই। বাইরে থেকে কেউ… থেমে গেল সে।
আরে! তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে মুসার কণ্ঠ। ঝোঁপের ভেতর কে জানি লুকিয়ে আছে!…একটা ছেলে! ও জানে না, আমি ওকে দেখতে পাচ্ছি। ধরব ওকে।
দাঁড়াও! বলে উঠল কিশোর। আমরা আসছি। একা যেয়ো না।
তোমরা বেরোলেই হয়ত দেখে ফেলবে, শোনা গেল মুসার কণ্ঠ। আমিই যাচ্ছি। ওর পথ আটকে জানাব তোমাদের। সঙ্গে সঙ্গে ছুটবে।
ঠিক আছে, বলল কিশোর। ওকে ধরেই চেঁচিয়ে উঠবে। ছুটে আসব আমরা। প্রফেসরের দিকে ফিরল সে। ঝোঁপের ভেতর লুকিয়ে বসে আছে একজন। ওকে ধরতে পারলে হয়ত রহস্যটার সমাধান হয়ে যাবে।
নীরবতা।
এতক্ষণ কি করছে ও! অসহিষ্ণু কণ্ঠে বলল রবিন। কিছুই বলছে না মুসা! দেখাও যাচ্ছে না এখান থেকে!
আবার নীরবতা। অপেক্ষা করছে ওরা।
.
পা টিপে টিপে এগোচ্ছে মুসা। কানের কাছেই ধরা রয়েছে রেডিও। ঝোঁপের মধ্যে পেছন ফিরে বসে বাড়ির সামনের দিকে নজর রাখছে লোকটা। ঝোঁপের একেবারে কাছে চলে এল মুসা। এক মুহূর্ত অপেক্ষা করল। তারপর প্রায় ডাইভ দিয়ে ঢুকে গেল ঝোঁপের ভেতরে। ঝোঁপঝাড় ভেঙে ছেলেটাকে নিয়ে পড়ল মাটিতে। উপুড় হয়ে হাত পা ছড়িয়ে পড়েছে ছেলেটা। তার ওপর মুসা। চেঁচিয়ে উঠল, জলদি এস! ওকে ধরেছি!
কথা বলে উঠল ছেলেটা। বিদেশী ভাষা। এক বর্ণ বুঝল না মুসা। ধস্তাধস্তি করছে ছেলেটী। তাকে জোর করে চেপে ধরে রেখেছে। হঠাৎ ছেলেটার হাতের আঘাতে মুসার হাত থেকে ছুটে পড়ে গেল রেডিও। ওটা তোলার চেষ্টা না করে দুহাতে ছেলেটাকে জাপটে ধরল মুসা। ঢাল বেয়ে গড়াতে শুরু করল দুজনে।
প্রায় মুসারই সমবয়েসী হবে ছেলেটা। লম্বা-চওড়ায় কিছুটা কম, তবে গায়ের জোর কম না। কায়দা-কৌশলও জানে মোটামুটি বান মাছের মত পিছলে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছে মুসার আলিঙ্গন থেকে। একবার ছুটে বেরিয়ে গেল। কিন্তু খাড়া হওয়ার আগেই আবার তাকে ধরে ফেলল মুসা। ঢাল বেয়ে গড়িয়ে গিয়ে একটা পাথরের দেয়ালে ঠেকে গেল দুজনে। আবার কথা বলে উঠল ছেলেটা। কিছুই বুঝল না মুসা। বোঝার চেষ্টাও করল না। তার একমাত্র চিন্তা, ছেলেটাকে আটকে রাখতে হবে রবিন আর কিশোর না পৌঁছানো পর্যন্ত।
.
ওয়াকি-টকিতে মুসার চিৎকার শুনেই দরজার দিকে দৌড় দিল রবিন। তার পেছনে কিশোর ও প্রফেসর বেনজামিন।
সদর দরজায় বেরিয়েই দেখতে পেল, তাদের আগে ছুটছে আরেকজন লোক। নীল ওভারঅল পরা। ছুটতে ছুটতেই বেলচাটা ফেলে দিয়েছে হাত থেকে।
কে লোকটা? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
প্রফেসর বললেন, মালী।
ঢাল বেয়ে নামতে নামতে দেখল ওরা, ছেলে দুটোর কাছে পৌঁছে গেছে মালী। মুসাকে সরিয়ে দিয়ে অন্য ছেলেটার গলা চেপে ধরল। টেনে তুলে দাঁড় করিয়ে দিল, গলা ছাড়ল না।
উঠে দাঁড়াল মুসা। হাত-পায়ের ধুলো ঝাড়তে লাগল। মালীর দিকে চেয়ে বলল, শক্ত করে ধরুন। ওটা একটা বনবেড়াল!
দুর্বোধ্য ভাষায় আবার কিছু বলে উঠল ছেলেটা। গলায় মালীর হাত, গোঁ গোঁ করে এক ধরনের চাপা শব্দ বেরোল কথার সঙ্গে।
বিদেশী ভাষায় চেঁচিয়ে কিছু বলল মালী, ছেলেটার কথার জবাব দিচ্ছে। বোধহয়। মাঝপথেই আর্তনাদ করে উঠল লোকটা। ঝটকা দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়েই ছুটল ছেলেটা। ঢাল বেয়ে ছুটে গিয়ে ঢুকে পড়ল আরেকটা ঝোপে। আর ধরা যাবে না ওকে। বিমূঢ়ের মত দাঁড়িয়েই রয়েছে মুসা।
ঠিক এই সময় পৌঁছে গেল রবিন, কিশোর আর প্রফেসর।
কি হল? মালীর দিকে চেয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন প্রফেসর। তোমার হাত থেকে ছুটল কি করে ছেলেটা?
প্রফেসরের দিকে ফিরল মালী, হাতে কামড়ে দিয়েছে, স্যার! ডান হাতটা সামনে বাড়িয়ে দিল সে। কব্জির নিচে চামড়ায় দাঁতের দাগ, রক্ত বেরিয়ে এসেছে।
এত বড় দেহটা রেখেছ কেন!…একটা বাচ্চা ছেলেকে—
ও কামড়ে দেবে, বুঝতে পারিনি, স্যার।
হু! যাও, জলদি ওষুধ লাগাও। দাঁতে বিষাক্ত কিছু থাকতে পারে। ইনফেকশন হলে বুঝবে ঠেলা। জলদি যাও।