কিন্তু কি?
আমাদের কার্ড। যেটার পেছনে টেরর ক্যাসল লিখেছিলে তুমি…
হারিয়েছে, না? টেবিলে রেখেছিলে, কাজ করে ফিরে এসে আর পাওনি, বলল কিশোর।
তুমি জানলে কি করে? রবিন অবাক।
সহজ। না হারালে ওটার কথা তুলতে না তুমি।
টেবিলে রেখে ক্যাটালগ গোছাচ্ছিলাম, বলল রবিন। মনে পড়তেই তুলে নিতে এলাম। পেলাম না। অনেক খুঁজেছি। শুটকো নিয়েছে, এটাও জোর দিয়ে বলতে পারছি না। তবে বেরিয়ে যাবার সময় ব্যাটাকে খুব খুশি খুশি মনে হয়েছে।
শুঁটকোর কথা যথেষ্ট হয়েছে, বলল কিশোর। একটা জরুরি কাজ হাতে নিয়েছি আমরা। সময় নষ্ট করা চলবে না। টেরর ক্যাসলের ব্যাপারে কি জানলে, বল।
বেশ, শুরু করল রবিন। হলিউড ছাড়িয়ে গেলে একটা সরু গিরিপথ পাওয়া যাবে। নাম ব্ল্যাক ক্যানিয়ন। ওই গিরিপথের এক ধারে পাহাড়ের ঢালে তৈরি হয়েছে টেরর ক্যাসল। এটার নাম ছিল আসলে ফিলবি ক্যাসল। বিখ্যাত অভিনেতা জন ফিলবির বাড়ি সে-ই তৈরি করিয়েছিল। নির্বাক-সিনেমার যুগে লোকের মুখে মুখে ফিরত ফিলবির নাম। থামল রবিন।
বলে যাবার ইঙ্গিত করল। কিশোর।
টেরর ছবিতে অভিনয় করত ফিলবি। এই ভ্যাম্পায়ার কিংবা ওয়্যারউলভূস মার্কা ছবিগুলো আরকি। ওসব ছবিতে সাধারণত পোড়ো বাড়ি দরকার পড়েই। প্ল্যান করে ওই মডেলেরই একটা বাড়ি তৈরি করল। ফিলবি। ঘরে ঘরে ভরল যত্তোসব উদ্ভট জিনিস। মমির কফিন, বহু পুরানো লোহার বর্ম, মানুষের কঙ্কাল, এমনি সব জিনিস। কোনটাই কিনতে হয়নি তাকে। ছবিতে ব্যবহার হয়ে যাবার পর প্রযোজকের কাছ থেকে চেয়ে নিয়েছে।
ভরসা পাচ্ছি, আস্তে করে বলল কিশোর।
শেষতক শোন আগে, বলল মুসা। তা জন ফিলবির কি হল?
আসছি সে কথায়, বলল রবিন। লক্ষমুখো মানব নামে সারা দুনিয়ায় খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল ফিলবির। এই সময়েই এল সবাক সিনেমা। চমৎকার অভিনয় ফিলবির, কিন্তু কথা বলতে গেলেই গুবলেট হয়ে যায়। চি-চি গলার স্বরা শুধু তাই না, জোরে বলতে গেলে কথা জড়িয়ে যায়। কখনও কোন শব্দের বেলায় তোতলায়ও।
ই-স্-স্ আফসোস করে উঠল মুসা। চি-চি করা ওই তোতলা ভুতকে সিনেমায় যদি দেখতে পেতামা হাসতে হাসতে নিশ্চয় পেট ব্যথা হয়ে যেত লোকের!
তা-ই হত, সায় দিল রবিন। ছবিতে অভিনয় বন্ধ করে দিল ফিলবি। বেহিসেবী, খরুচে ছিল সে। জমানো টাকা পয়সা তেমন ছিল। না। কােজ নেই, টাকাও আসে না। একে একে সবকটা কাজের লোককে বিদেয় করে দিতে বাধ্য হল। সব শেষে বিদেয় করল তার বিজনেস ম্যানেজার হ্যারি প্রাইসকে। লোকের সঙ্গে ফোনে কথা বলা বন্ধ করে দিল। ফোন আসে, ধরে না, চিঠি আসে, জবাব দেয় না। নিজেকে গুটিয়ে নিল ক্যাসলের সীমানায়। ধীরে ধীরে অভিনেতা ফিলবিকে ভুলে গেল লোকে। থামল রবিন। দম নিয়ে আবার বলতে লাগল, তারপর একদিন, হলিউডের মাইল পচিশোক উত্তরে পড়ে থাকতে দেখা গেল একটা গাড়ি। ভেঙে চুরে দুমড়ে আছে। পাহাড়ী পথ থেকে নিচের পাথুরে সৈকতে পড়ে গিয়ে ওই অবস্থা হয়েছে। ওটার। চুরচুর হয়ে গেছে কাচ। ভেঙে, খুলে দশহাত দূরে ছিটকে পড়েছে একটা দরজা।
ওই গাড়ির সঙ্গে ফিলবির সম্পর্ক কি? রবিনের কথার মাঝেই প্রশ্ন করে বসল মুসা।
লাইসেন্স নাম্বার দেখে পুলিশ জানতে পারল, গাড়িটা ফিলবির, ব্যাখ্যা করল রবিন। অভিনেতার লাশ পাওয়া যায়নি। এতে অবাক হবারও কিছু নেই। নিশ্চয় খোলা দরজা দিয়ে বাইরে ছিটকে পড়েছিল দেহটা। তারপর জোয়ারের সময় ভেসে গেছে সাগরে।
আহু-হা দুঃখ প্রকাশ পেল মুসার গলায়। তোমার কি মনে হয়? ইচ্ছে করেই অ্যাক্সিডেন্ট করেছিল লোকটা?
শিওর না, জবাব দিল রবিন। গাড়িটা সনাক্ত করার পরই ক্যাসলে গিয়ে উঠল পুলিশ। সদর দরজা খোলা। ভেতরে কেউ নেই। পুরো ক্যাসল খুঁজল পুলিশ। কোন লোককেই পাওয়া গেল না। লাইব্রেরিতে একটা টেবিলে পেপারওয়েট চাপা দেয়া একটা নোট পাওয়া গেল, কপি করে আনা নোটটা বাদামী খামের ভেতর থেকে খুলে পড়ল। রবিনঃ লোকে আর কোনদিনই জীবন্ত দেখতে পাবে না। আমাকে। কিন্তু তাই বলে একেবারে হারিয়ে যাব না। আমি। আমার আত্মা ঠিকই বিচরণ করবে তোমাদের মাঝে। আর, মরার পরেও আমার সম্পত্তি হয়ে রইল টেরর ক্যাসল। ওটা এই মুহূর্ত থেকে একটা অভিশপ্ত দুৰ্গ। — জন ফিলবি।
ইয়াল্লা! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল মুসা। দুৰ্গটার ব্যাপারে যতই শুনছি, ততই অপছন্দ করছি ওটাকে!
থামলে কেন? রবিনকে বলল কিশোর। বলে যাও।
ক্যাসলের আনাচে-কানাচে কোথাও খোঁজা বাকি রাখল না। পুলিশ। না, ফাঁকি বুকি কিছুই নেই। গাড়িটা ভেঙে ফেলে দিয়ে এসে বাড়িতে লুকিয়ে বসে থাকেনি ফিলবি। পরে জানা গেল, ব্যাংকে পাহাড়-প্রমাণ ঋণ হয়ে আছে তার। বাড়িটা মটগেজ রয়েছে ব্যাংকের কাছে। ফিলবি আত্মহত্যা করেছে, শিওর হয়ে নিয়ে ক্যাসলে লোক পাঠাল ব্যাংক। তার জিনিসপত্র সব তুলে নিতে এল ওরা। কিন্তু অদ্ভুত একটা ব্যাপার ঘটল। কেন জানি থতমত খেয়ে গেল লোকেরা বাড়িতে ঢুকেই। উদ্ভট কিছু শব্দ শুনল ওরা, আজব কিছু চোখে পড়ল। কিন্তু কি শুনেছে, কি দেখেছে, পরিষ্কার করে বলতে পারল না। মালপত্ৰ আর বের করা হল না। নিজেরাই ছুটে বেরিয়ে এল। বাড়িটা বিক্রির সিদ্ধান্ত নিল। এরপর ব্যাংক। লাভ হল না। লোকে থাকতেই চায় না। ক্যাসলে, কিনতে যাবে কে শুধু শুধু? যে-ই ঢোকে বাড়িটাতে, খানিক পরেই কেমন অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করে। থেমে দুই বন্ধুর দিকে একবার চেয়ে নিল রবিন। কিশোরের কোন রকম ভাব পরিবর্তন নেই। হাঁ করে আছে মুসা। আবার বলল সে, সস্তায় এতবড় একটা বাড়ি কেনার লোভ ছাড়তে পারল না। একজন এস্টেট এজেন্ট। ভূতফুত কিছু নেই, সব বাজে কথা! — প্রমাণ করতে এগিয়ে চলল সে। ঠিক করল, রাত কাটাবে ফিলবি ক্যাসলে। সাঁঝের আগেই ক্যাসলে। ঢুকাল সে। মাঝরাত পেরোনোর আগেই পাগলের মত ছুটে বেরিয়ে এল। ব্ল্যাক ক্যানিয়ন পেরোনোর আগে একবারও আর পেছন ফিরে তাকায়নি।