দরজার সামনে এসে থামল গাড়ি। বন্ধ পাল্লা। হর্নের আওয়াজ শুনে পাল্লার একদিকের ছোট একটা গর্তের সামনে থেকে ঢাকনা সরে গেল। উঁকি দিল একটা গোমড়া মুখ। কোথায় যাবেন?
জানালা দিয়ে ক্রি মুখ বের করে দিল হ্যানসন। মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার।
পাস আছে?
পাসের দরকার নেই। টেলিফোন করেই এসেছি।
মিছে কথা বলেনি হ্যানসন। ঠিকই টেলিফোন করে ছিল কিশোর। মিসটার ক্রিস্টোফারকে লাইন দেয়া হয়নি, সেটা তার দোষ না।
ও-ও! অনিশ্চিতভাবে মাথা চুলকাচ্ছে দারোয়ান।
ঠিক এই সময় পেছনের একপাশে সাইড উইন্ডো খুলে গেল। বেরিয়ে এল কিশোরের মুখ। এই যে ভাই, কি হয়েছে? দেরি কেন?
দারোয়ানের দিকে চোখ মুসার। কিশোরের কথা কানে যেতেই চমকে উঠল। কেমন ঘড়ঘড়ে গলা, কথায় খাঁটি ব্রিটিশ টান। ফিরে চাইল। ইয়াল্লা! প্ৰায় চেঁচিয়ে উঠল সে।
এ কোন কিশোরকে দেখছে! ঝুলে পড়েছে নিচের ঠোঁট। মাড়ি বেরিয়ে পড়ছে। মাথা সামান্য পেছনে হেলানো। নাকের ওপর দিয়ে চেয়ে আছে। বিচ্ছিরি! মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের কিশোর সংস্করণ, কোন খুঁত নেই। এক সময় টিভিতে অভিনয় করে প্রচুর নাম কামিয়েছে কিশোর। এ-অঞ্চলে তখন ছিল না মুসা। কিশোরের সেসব অভিনয় দেখেনি। তবে আজ বুঝতে পারল, লোকে কেন কিশোর পাশার নাম রেখেছ নকল পাশা।
হাঁ করে কিশোরের দিকে চেয়ে আছে দারোয়ান। রা নেই মুখে।
ঠিক আছে, নাকের ওপর দিয়ে দারোয়ানের মাথা থেকে পা পর্যন্ত নজর বোলাল একবার কিশোর, মিস্টার ক্রিস্টোফারের অনুকরণে। সন্দেহ থাকলে ফোন করছি আমি চাচাকে।
সোনালি রিসিভারটা বের করে আনল কিশোর। কানে ঠেকাল। বোতাম টিপে দিয়ে নিচু গলায় নাম্বার চাইল। আসলে পাশা স্যালভিজ ইয়ার্ডের নাম্বার। সত্যিই তার চাচার লাইন চেয়েছে কিশোর।
দামি গাড়িটার দিকে আরেকবার চাইল দারোয়ান। সোনালি রিসিভারটা দেখল। কিশোরের টেলিফোন কানে ঠেকিয়ে কথা বলার ভঙ্গিটা দেখল। তারপর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। ঠিক আছে, আপনার ফোন করার দরকার নেই। আমিই জানিয়ে দিচ্ছি, আপনারা তাঁর অফিসে যাচ্ছেন।
থ্যাঙ্ক ইউ।
খুলে গেল দরজা। হ্যানসন, আগে বাড়ো। গম্ভীর গলায় দারোয়ানকে শুনিয়ে শুনিয়ে আদেশ দিল কিশোর।
সূক্ষ্ম একটা হাসির রেখা দেখা দিয়েই মিলিয়ে গেল হ্যানসনের ঠোঁটে। সাঁ করে গাড়ি ঢুকিয়ে নিল সে ভেতরে।
এগিয়ে চলল। গাড়ি। অনেকখানি এগিয়ে মোড় নিল একদিকে। সরু পথ। দুধারে সবুজ লনের পথঘেষা প্রান্তে পাম গাছের সারি। লনের ওপারে ছবির মত সুন্দর ছিমছাম। ছোট আকারের ডজনখানেক বাংলো। নাক বরাবর সোজা পথের শেষ মাথায় বিশাল অনেকগুলো শেড। স্টুডিও। একটা শেডের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন অভিনেতা-অভিনেত্রী।
গেটের বাধা ডিঙিয়ে এসেছে, স্টুডিওতে ঢুকে পড়েছে ওরা। এখনও মাথায় ঢুকছে না। মুসার, মিস্টার ক্রিস্টোফারের সঙ্গে কি করে দেখা করবে। কিশোর বেশিক্ষণ ভাবার সময় পেল না সে। একটা বড় বাংলোর সামনে এনে গাড়ি রেখেছে। হ্যানসন। বোঝা গেল, আগেও এসেছে। এখানে। পথঘাট সব চেনা। বাংলোর দেয়ালে এক জায়গায় বড় বড় করে লেখাঃ ডেভিস ক্রিস্টোফার। আলাদা আলাদা বাংলোতে বিভিন্ন পরিচালকের অফিস। কে কোথায় বসেন, বোঝার জন্যেই এই নাম লেখার ব্যবস্থা।
আপনি বসুন গাড়িতে, পেছনের দরজা ধরে দাঁড়ানো হ্যানসনকে বলল কিশোর। বেরিয়ে এল। কতক্ষণে ফিরব বলা যায় না।
ঠিক আছে, স্যার।
সিঁড়ি ভেঙে বারান্দায় উঠল কিশোর, পেছনে মুসা। সামনের স্ত্রীনডোর ঠেলে ভেতরে পা রাখল। এয়ার কন্ডিশনড রিসিপশন রুম। একটা ডেস্কের ওপাশে বসে আছে সোনালিচুলো একটা মেয়ে। সবে নামিয়ে রাখছে। রিসিভার। অনেকদিন দেখা নেই। হঠাৎ বেড়ে ওঠা কেরি ওয়াইন্ডারকে প্ৰথমে চিনতেই পারল না মুসা, গলার আওয়াজ শুনে নিশ্চিত হতে হল।
তাহলে, কোমরে দুহাত রেখে উঠে দাঁড়িয়েছে মুরুব্বী, ঢুকেই পড়েছ? মিস্টার ক্রিস্টোফারের ভাতিজা! বেশ, কত তাড়াতাড়ি স্টুডিওতে পুলিশকে আনানো যায়, দেখছি। টেলিফোনের দিকে হাত বাড়াল কেরি। র দিকে হাত বাড়াল কেরি।
একেবারে চুপসে গেল মুসা। বিড়বিড় করে বলল, ইয়াল্লা!
থাম! বলে উঠল কিশোর।
কেন? সামনের দিকে চিবুক বাড়িয়ে দিয়ে আলতো মাথা ঝাঁকাল কেরি। গার্ডকে ফাঁকি দাওনি তুমি? বলনি মিস্টার মিস্টার ক্রিস্টোফারের ভাতিজা…
না, বলেনি, বন্ধুর পক্ষে সাফাই গাইল মুসা। গার্ডই ভুল করেছে।
তোমাকে কথা বলতে কে বলেছে? ধমকে উঠল কেরি। প্রায়ই গোলমাল করে কিশোর পাশা। স্কুকের অন্যের ব্যাপারে না গলানোর অনেক উদাহরণ আছে। এবার কিছুটা শিক্ষা দিয়ে ছাড়ব আমি।
ঘুরে রিসিভারের দিকে ঝুঁকল কেরি। হাত বাড়াল রিসিভারের দিকে।
তাড়াহুড়ো করে কিছু করা উচিত নয়, মিস ওয়াইল্ডার, বলল কিশোর
আবার চমকে উঠল মুসা। আবার পুরোদস্তুর ইংরেজ, কথায় সেই অদ্ভুত টান-মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফার যেভাবে কথা বলেন। চিকিতে আবার কিশোর ক্রিস্টোফার হয়ে গেছে কিশোর।
আমি শিওর, এটা দেখতে চাইবেন মিস্টার ক্রিস্টোফার, বলল কিশোর।
রিসিভার হাতে তুলে নিয়েছে কেরি। কিশোরের কথায় ফিরে চাইল। সঙ্গে সঙ্গে খসে পড়ে গেল রিসিভার। চোখ বড় বড় হয়ে গেছে, ছিটকে বেরিয়ে আসবে যেন কোটির ছেড়ে। কেবল থেকে ঝুলছে রিসিভারটা। টেবিলের পায়ার সঙ্গে বাড়ি খাচ্ছে খটাখট, কানেই ঢুকছে না যেন তার। তুমি… তুমি… ফিসফিস করছে সে, …তুমি… হঠাৎই ভাষা খুঁজে পেল যেন কেরি। হ্যাঁ, কিশোর পাশা, সত্যিই বলেছ। এটা দেখতে চাইবেন মিস্টার ক্রিস্টোফার!