অবশেষে হাজির হল বিশাল রোলস রয়েস। গাড়িটার উজ্জ্বলতার কাছে নিজেদেরকে একেবারে স্নান মনে হল দুজনের। পুরানো ধাঁচের ক্লাসিক্যাল চেহারা। প্ৰকাণ্ড দুটো হেডলাইট। চৌকো, বাক্সের মত দেখতে মূল শরীরটা কুচকুচে কালো। চকচকে পালিশ, মুখ দেখা যায়।
খাইছোঁ কিশোরের মুখে শোনা বাঙালী বুলি ঝাড়ল মুসা। এগিয়ে আসা গাড়িটার দিকে অবাক চোখে চেয়ে আছে। একশো দশ বছর বয়েসী কোটিপতির উপযুক্ত!
পৃথিবীর সবচেয়ে দামি গাড়ির একটা, বলল কিশোর। কোটিপতি এক আরব শেখের অর্ডারে তৈরি হয়েছিল। এই গাড়িও নাকি পছন্দ হয়নি শেখের। ফলে ডেলিভারি নেয়নি। কম দামে পেয়ে কিনে নিয়েছে রেন্ট-আ-রাইড কোম্পানি। নিজেদের বিজ্ঞাপনের কাজে ব্যবহার করছে।
কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল রোলস রয়েস। ঝটিকা দিয়ে খুলে গেল দরজা। ড্রাইভিং সিট থেকে দ্রুত নেমে এল শোফার। ছয় ফুট লম্বা, আট-সাট দেহের গড়ন। লম্বাটে হাসিখুশি চেহারা। একটানে মাথার টুপি খুলে হাতে নিয়ে নিল।
মাস্টার পাশা? সপ্রশ্ন চোখে কিশোরের দিকে চেয়ে বলল লোকটা। আমি হ্যানসন, শোফার।
পরিচিত হয়ে খুশি হলাম, মিস্টার হ্যানসন, বলল কিশোর। আমাকে কিশোর বলে ডাকবেন, আর সবাই যেমন ডাকে।
প্লীজ, স্যার, দুঃখ পেয়েছে যেন শোফার, আমাকে শুধু হ্যানসন বলবেন। আপনাকে নাম ধরে ডাকা উচিত হবে না। কারণ এখন আপনার অধীনে কাজ করছি আমি। বেয়াদবী করতে চাই না।
ঠিক আছে, শুধু হ্যানসন, বলল কিশোর।
থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার। আগামী তিরিশ দিনের জন্যে এই গাড়ি আপনার।
চব্বিশ ঘন্টার জন্যে নিশ্চয়? শর্ত তাই ছিল।
নিশ্চয়, স্যার। পেছনের দরজা খুলে ধরল হ্যানসন। প্লীজ।
থ্যাঙ্ক ইউ, বলে গাড়িতে উঠল কিশোর। মুসাও ঢুকল। হ্যানসনের দিকে চেয়ে বলল কিশোর, বেশী ফর্মালিটির দরকার নেই। দরজা আমরাই খুলতে পারব।
কিছু মনে করবেন না, স্যার, বলল। ইংরেজ শোফার, চাকরির পুরো দায়িত্ব পালন করতে দিন আমাকে। ঢিল দিয়ে নিজের স্বভাব নষ্ট করতে চাই না।
পেছনের দরজা বন্ধ করে দিল হ্যানসন। সামনের দরজা খুলে ড্রাইভিং সিটে বসল।
কিন্তু মাঝেমধ্যে তাড়াহুড়ো করে বেরোতে কিংবা ঢুকতে হতে পারে আমাদের, বলল কিশোর। তখন আপনার জন্যে অপেক্ষা করতে পারব না। তবে এক কাজ করা যায়। শুরুতে একবার দায়িত্ব পালন করবেন। আপনি, আরেকবার একেবারে বাড়ি ফিরে। মাঝে যতবার খোলা বা বন্ধ করার দরকার পড়বে, আমরা করব। ঠিক আছে?
ঠিক আছে, স্যার। সুন্দর সমাধান।
রিয়ার ভিউ মিররে চোখ পড়ল কিশোরের। তার দিকে চেয়ে হাসছে। হ্যানসন। তাড়াতাড়ি বলল কিশোর, অনেক সম্ভ্রান্ত লোকের কাজ করেছেন নিশ্চয়? বুঝতেই পারছি, ওরা কেউই আমাদের মত ছিল না। অনেক আজব, উদ্ভট জায়গায় যেতে হতে পারে আমাদের, কাজ করতে… একটা কার্ড নিয়ে হ্যানসনের দিকে বাড়িয়ে ধরল সে। এটা দেখলেই আন্দাজ করতে পারবেন।
গম্ভীর মুখে কার্ডটা ফিরিয়ে দিতে দিতে বলল হ্যানসন, বুঝতে পেরেছি, স্যার। আপনাদের কাজ করতে আমার খুবই ভাল লাগবে। কিশোর অ্যাডভেঞ্চারের কাজ করে একঘেয়েমিও কাটাতে পারব। এতদিন শুধু বুড়োদের চাকরি করেছি, সবাই বাড়ি থেকে অফিস কিংবা অফিস থেকে বাড়ি। মাঝেমধ্যে পাটিতে যেত, ব্যস। তো এখন কোথায় যাব, স্যার?
হ্যানসনকে খুব পছন্দ হয়ে গেছে দুই গোয়েন্দার। লোকটা সত্যিই ভাল। তাদেরকে মোটেই অবহেলা করছে না।
হলিউডে, প্যাসিফিক স্টুডিওতে, বলল কিশোর। মিস্টার ডেভিস ক্রিস্টোফারের সঙ্গে দেখা করব। গতকাল ফোনে… মানে, টেলিফোন করেছিলাম তাঁকে।
যাচ্ছি, স্যার।
মৃদু গুঞ্জন করে উঠল রোলস রয়েসের দামি ইঞ্জিন। এতই মৃদু যে শোনাই যায় না প্রায়। পাহাড়ী পথ ধরে মসৃণ গতিতে হলিউডের দিকে ছুটল রাজকীয় গাড়ি।
সামনে পথের ওপর দৃষ্টি রেখে বলল হ্যানসন, গাড়িতে টেলিফোন আছে। একটা রিফ্রেশমেন্ট কম্পার্টমেন্টও আছে। চাইলে ব্যবহার করতে পারেন।
থ্যাঙ্ক ইউ, গম্ভীর গলায় বলল কিশোর। এত দামি একটা গাড়িতে চড়ে নিজেকে হোমরা-চোমরা গোছের কেউ একজন ভাবতে শুরু করেছে। ইতিমধ্যেই। সামনের সিটের পেছনে বসানো একটা খোপের ছোট্ট দরজা খুলে ফেলল বোতাম টিপে। বের করে আনল। টেলিফোন রিসিভারটা। এত সুন্দর রিসিভার জীবনে দেখেনি সে। সোনালি রঙ। চকচকে পালিশ। কোন ডায়াল নেই। একটা বোতাম আছে শুধু।
মোবাইল টেলিফোন, জানাল হ্যানসন। বোতামে শুধু একবার চাপ দিলেই যোগাযোগ হয়ে যাবে অপারেটরের সঙ্গে। তাকে নাম্বার জানালে লাইন দিয়ে দেবে। খুব সহজ।
রিসিভারটা আবার আগের জায়গায় রেখে দিল কিশোর। আরাম করে হেলান দিয়ে বসল নরম চামড়া মোড়ানো পুরু গদিতে।
দেখতে দেখতে হলিউডে এসে ঢুকল গাড়ি। ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর ধার দিয়ে চলেছে এখন। গন্তব্যস্থান যতই কাছিয়ে আসছে, অস্থির হয়ে উঠছে মুসা। খালি উসখুসি করছে, কিশোর, শেষে বলেই ফেলল। সে। বুঝতে পারছি না। স্টুডিওর গেট পেরোবে কি করে! আমাদেরকে কিছুতেই ঢুকতে দেবে না দারোয়ান। ওই গেটই পেরোতে পারব না আমরা।
উপায় একটা ভেবে রেখেছি, বলল কিশোর। কাজে লাগলেই হয়। এই যে, এসে গেছি।
উঁচু বিশাল এক দেয়ালের ধার দিয়ে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। বড় বড় দুটো ব্লক পেরিয়ে এল। সামনের দেয়ালের গায়ে বিরাট লোহার দরজা। গেটের কপালে বড় বড় করে লেখাঃ প্যাসিফিক স্টুডিও।